ব্যাঙ্কশাল কোর্টে কুণাল ঘোষ। বুধবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
আফ্রিকার রাজা, শশীবাবুর সিং আর আখতারির গান।
‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ তখন এগোচ্ছে ক্লাইম্যাক্সের দিকে। কিন্তু এই তিন খটকার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ফেলুদার কপালের ভ্রূকুটি যাচ্ছে না। যা শুনে জটায়ু আবার ‘হযবরল’ ধার করে বললেন, “বোঝো! চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ আর রুমালের মা।”
কুণাল ঘোষ অবশ্য ভুরু কুঁচকে নেই ফেলুদার মতো। তাঁর মেজাজ ফুরফুরে। তিনি বলছেন, “ক্রিকেট বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো, ক্রিস গেইলের ব্যাটিং এবং বুদ্ধদেবের (ভট্টাচার্য) দাড়ি।”
বুধবার কলকাতার নগর দায়রা আদালত থেকে জেলের গাড়িতে ওঠার সময় সাংবাদিকেরা বন্দি সাংসদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, চার পাশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী। তার উত্তরেই টেনশন-বিহীন প্রাক্তন সাংবাদিক বলেন, “সম্প্রতি তিনটে জিনিস আমার ভাল লেগেছে।”
কী কী? উত্তরটা আগেই তুলে দেওয়া হয়েছে।
শুধু মুখের কথাতেই নয়, কুণালের শরীরী ভাষাতেও এ দিন খোশমেজাজ ফুটে বেরিয়েছে। তাতে আর যে-ই হোক, লালবাজারের কর্তারা অন্তত হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। তাঁদের একাংশ বলছেন, গত এক বছরে কুণাল কার্যত আতঙ্ক হয়ে উঠেছিলেন পুলিশের কাছে। কখনও সারদা কেলেঙ্কারিতে মুখ্যমন্ত্রীকে জড়িয়ে তাঁর পদত্যাগ চাইছিলেন, কখনও আদালতে নথি পেশ করছিলেন। তাঁর মুখ আটকাতে ‘হা-রে-রে’ করে চিৎকার জুড়তেন এক দল পুলিশ। আর এক দল ব্যস্ত থাকতেন প্রিজন ভ্যানের গায়ে ‘ধাঁই-ধপাধপ’ বাজনা বাজানোয়। এমনকী কুণালের মুখ বন্ধ করতে ব্যাঙ্কশাল আদালত চত্বরে তাঁর গলা টিপে ধরেছে পুলিশ, এই দৃশ্যও দেখা গিয়েছিল। তার ওপর আবার রীতিমতো চরমসীমা ঘোষণা করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন কুণাল। তার জেরে পুলিশকর্তাদের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে। এই অবস্থায় বিদ্রোহী সাংসদের মুখে রসিকতা শুনে তাঁদের বুক থেকে পাথর তো নামবেই।
কেন কুণাল ফুর্তিতে?
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারদা কাণ্ডে শাসক দলের উত্তরোত্তর বিড়ম্বনা বৃদ্ধিই এর প্রধান কারণ। গ্রেফতার হওয়ার পর নিজের গণ্ডি এবং সংগঠন থেকে কুণালকে ঝেড়ে ফেলতে বিন্দুমাত্র সময় নেননি দলনেত্রী ও শীর্ষ নেতারা। কুণাল বারবার দাবি করেছেন, তাঁকে ফাঁসিয়ে ‘রাঘব বোয়ালরা’ মজা দেখছেন। তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা সে সময় উপহাসই করেছেন কুণালকে।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি ঘোরালো। একে তো সারদা মামলায় পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র জেলে রয়েছেন। তার উপর তৃণমূলের কাছে নতুন বিড়ম্বনা হয়ে উঠেছেন মুকুল রায়। সারদার আঁচেই যাঁর সঙ্গে ক্রমশ দূরত্ব বেড়েছে তৃণমূল নেত্রীর। ডেলো পাহাড়ে নেত্রীর সঙ্গে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের বৈঠক হয়েছিল বলে দাবি করেছিলেন কুণাল। সিবিআইয়ের তলব পেয়ে মুকুল সেই বৈঠক-সহ আরও অনেক গুপ্ত কথার ঝুলি উপুড় করে দিয়ে এসেছেন বলে গোয়েন্দা-সূত্রের খবর। আজ দলনেত্রী মুকুলকেও ঝেড়ে ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অথচ মুকুল রয়েছেন ঠান্ডা মাথায়। দলীয় শৃঙ্খলা মেনে, বিন্দুমাত্র বেচাল না চেলে নেত্রীর অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলেছেন তিনি।
এমন সঙ্কটের দিনে খোদ নেত্রীর বিরুদ্ধেই সরব হতে শুরু করেছেন দলীয় নেতাদের একাংশ। শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে মঙ্গলবার শো-কজ করা হয়েছিল মুর্শিদাবাদের নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী হুমায়ুন কবীরকে। এ দিন তিনি মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের উদ্দেশে তোপ দেগেছেন। দলের একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিধানসভায় প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান করেছেন সিউড়ির বিধায়ক স্বপন ঘোষ। তাঁকে শেষমেশ সাসপেন্ড করা হয়। ঘটনাচক্রে, লোকসভা ভোটে মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্রে তৃণমূলের ভোট কমে যাওয়া নিয়ে দিন কয়েক আগে প্রশ্ন তুলেছিলেন মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু। তাঁর বিরুদ্ধে এখনও ব্যবস্থা নিতে পারেননি শীর্ষ নেতারা। এ সবেরই প্রভাব পড়েছে তৃণমূলের সংগঠনে।
ফলে রাজনীতির খবর যাঁরা রাখেন তাঁরা বলছেন, সারদা কেলেঙ্কারির আঁচে তৃণমূলে এমন আড়াআড়ি বিভাজন দেখে কুণালের খোশমেজাজে থাকাটাই স্বাভাবিক। অবশ্য পুলিশের একাংশ দাবি করেছে, এই কৃতিত্ব তাদেরই কয়েক জন অফিসারের।
পূর্ব পরিচিতির সূত্রে কুণালকে নাকি তাঁরা মুখ না খুলতে অনুরোধ করেছেন। লালবাজারের অন্দরের খবর, ইদানীং সেই অফিসারদেরই রোজ নগর দায়রা আদালতের ডিউটিতে পাঠানো হচ্ছে।
লক্ষ্যণীয় ভাবে এ দিন কুণালও আদালতে কোনও ‘বিদ্রোহের’ চেষ্টা করেননি। পুলিশি ঘেরাটোপে চুপচাপ বসেছিলেন। মাঝে সিবিআই আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক বরুণ রায়কে তিনি জানান, মায়ের সঙ্গে তাঁর একটি যৌথ অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর মা-ই ওই অ্যাকাউন্ট সামলাতেন। কিন্তু ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর এবং বয়সজনিত কারণে মা চেকে এখন যে সই করছেন, তা মিলছে না। ফলে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা যাচ্ছে না।
কুণালের আইনজীবী জানান, মায়ের সঙ্গে যৌথ অ্যাকাউন্ট ছাড়াও কুণালের নিজস্ব একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সেটিতে সাংসদ তহবিলের টাকা জমা হয়। ওই দু’টি অ্যাকাউন্ট সিবিআই বাজেয়াপ্ত করেনি। কিন্তু কুণালের পরিবারের লোকজন জেলে কুণালকে চেক সই করাতে গেলে কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিচ্ছেন না। এ ব্যাপারে সিবিআইয়ের আইনজীবী আদালতে জানান, সারদা-তদন্তে ওই দু’টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে কি না অথবা কুণাল ওই অ্যাকাউন্ট চালাতে পারবেন কি না তদন্তকারীদের কাছ থেকে না জেনে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।
এ দিন কুণালের সঙ্গে আদালতে ছিলেন সুদীপ্ত এবং দেবযানীও। আদালত তিন জনকেই ২ মার্চ পর্যন্ত জেল হেফাজতে পাঠিয়েছে। ওই দিন সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসারকেও কেস ডায়েরি নিয়ে হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
আসলে তত দিন অবধি চাপটা পুলিশেরই। বন্দি সাংসদের মেজাজ যেন বিগড়ে না যায়!