কোথাও আরাবুল ইসলাম, কোথাও বুলেট, কোথাও আবার আবু আয়েশ মণ্ডল। দলের বিভিন্ন মাপের নেতার বিরুদ্ধে মাতব্বরির অভিযোগ ওঠার পরে চাপের মুখে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু এ বার কাঠগড়ায় যিনি, দলে তাঁর ওজন যে আরাবুল বা আবু আয়েশের থেকে বেশি তা-ই নয়, তিনি বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার। এহেন সাংবিধানিক পদে থেকেও গভীর রাতে হাওড়ার এক আবাসনে গিয়ে যে কাণ্ড সোনালি গুহ ঘটিয়েছেন, তাতে দলের বিড়ম্বনা বহু গুণ বেড়েছে। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ক্ষুব্ধ বলে দলীয় সূত্রে খবর। তাঁর নির্দেশেই সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে সোনালির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। যদিও শাসক দলেরই একটা অংশ এবং বিরোধীরা বলছেন, না আঁচালে বিশ্বাস নেই।
সোনালি-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরে বৃহস্পতিবার কার্যত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে (যার মধ্যে মমতার বয়কট ঘোষণা করা এবিপি আনন্দও রয়েছে) দলের মুখপাত্র ও রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘হাওড়ায় যে ঘটনা ঘটেছে, তা দল সমর্থন করে না। দল উপযুক্ত সময়ে ব্যবস্থা নেবে।” তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বলেছেন, সোনালির ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। মুকুল রায়, সুব্রত বক্সী, সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং আমি মিলে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করব।”
কিন্তু চার জনের এই কমিটি যে রাতারাতি বসে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে, এমন ইঙ্গিত এ দিন রাত পর্যন্ত তৃণমূল সূত্রে মেলেনি। পার্থবাবুরা বরং অপেক্ষা করছেন দলনেত্রীর চূড়ান্ত নির্দেশের। এর আগে তাপস পালের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছিল, সেই একই চিত্রনাট্য মেনে সোনালি দুঃখপ্রকাশ করলেন, আর দিদি তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন এমনটা ঘটে কিনা, সেটা দেখার। যদিও দলের অনেকেই বলছেন, টোল প্লাজার কর্মীদের উপরে চড়াও হওয়ার অভিযোগ ওঠায় সরকারি পদ থেকে সদ্য ইস্তফা দিতে হয়েছে আবু আয়েশকে। সোনালির পদের ওজন আবু আয়েশের চেয়ে অনেক বেশি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।
‘দিদিগিরি’তে সোনালির নাম জড়ানো অবশ্য এই প্রথম নয়। মমতার স্নেহধন্যা এই ডাকসাইটে বিধায়ক একের পর এক কুকীর্তি করেও অতীতে ছাড় পেয়েছেন। থানায় গিয়ে ওসি-কে গালি দিয়ে দরজায় তালা লাগিয়েছেন, বিধানসভার লবিতে ভাঙচুরে হাত লাগিয়েছেন, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে অশালীন শব্দ ব্যবহার করেছেন এ রকম নানা অভিযোগে বারবার জড়িয়েছে তৃণমূল বিধায়ক সোনালির নাম। ক্ষমতায় এসে সেই সোনালিকেই যখন বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার পদে বসিয়েছিলেন মমতা, আঁতকে উঠেছিলেন অনেকে! তৃণমূল নেত্রীর যুক্তি ছিল, পদের বাঁধনেই বেঁধে ফেলা যাবে সোনালিকে। এত দিন সেই যুক্তি খেটেও গিয়েছিল। প্রকাশ্যে সেই বাঁধন ছিঁড়ে গেল সাড়ে তিন বছরের মাথায়!
ডেপুটি স্পিকারের এমন কাণ্ডে প্রত্যাশিত ভাবেই ছেড়ে কথা বলছে না বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু প্রশ্ন তুলেছেন, “যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী থানায় গিয়ে অভিযুক্তকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান, সেখানে তাঁর ডেপুটি স্পিকার এমন করলে আশ্চর্য হব কেন?” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেছেন, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বাঁশের কথা বলছেন। কী ভাবে বাঁশ দিতে হয় তা দেখাচ্ছেন। তাঁর দলের লোকেরা যে বাঁশ নিয়ে তাড়া করবে, এটাই স্বাভাবিক।” ঘটনার প্রতিবাদে আজ, শুক্রবার গোলাবাড়ি থানা ঘেরাও করার পরিকল্পনাও নিয়েছে হাওড়া জেলা বিজেপি।
নানা অভিযোগে নাম জড়ালেও ব্যক্তিগত স্তরে অবশ্য বয়োজ্যেষ্ঠ বিরোধী নেতাদের সঙ্গে সোনালির সম্পর্ক চিরকালই মধুর। কিন্তু ডেপুটি স্পিকার সোনালির আচরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন লোকসভা ও বিধানসভার দুই প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ও হাসিম আব্দুল হালিমও। আর বিধানসভার বর্তমান স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “বিষয়টি জানি না। তবে বিশ্বাস করতে পারছি না, সোনালি এই ধরনের কথা বলেছেন! যদি বলে থাকেন, তবে তা অনভিপ্রেত এবং আমি এতে অখুশি।”
হাওড়ার তৃণমূল নেতৃত্বও ঘটনায় বিরক্ত। স্থানীয় বিধায়ক হওয়া সত্ত্বে তাঁকে কিছু জানানো হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন অশোক ঘোষ। তাঁর কথায়, “দুই পড়শির মধ্যে ঝামেলা, এটা আমাকে জানালে আমিই ব্যবস্থা নিতে পারতাম!” হাওড়ার মেয়র রথীন চক্রবর্তী অবশ্য “বিষয়টি ব্যক্তিগত। আমি বিস্তারিত কিছু জানি না” বলেই দায় সেরেছেন। পার্থবাবু সোনালিকে ফোন করে প্রাথমিক ভাবে ঘটনার খোঁজও নিয়েছেন। সোনালি তাঁর কাছে দাবি করেছেন, টিভি-তে ঘটনা অতিরঞ্জিত করে দেখানো হচ্ছে!
বস্তুত, এ দিন পর্যন্ত সোনালির মনোভাব ‘কুছ পরোয়া নেহি’। তাঁর কটাক্ষ, “কেন্দ্রে মোদী-রাজ চলছে বলে কি এখানেও বর্বরতা শুরু হবে নাকি! এটা তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা!”