পরনে পুলিশের খাকি পোশাক, কিন্তু পুলিশ নয়। অথবা সিআরপি-র জংলা ইউনিফর্ম, কিন্তু সিআরপি নয়। লোকসভা ভোটের সময়ে পশ্চিমবঙ্গের চার জেলায় এই ধরনের ছদ্মবেশীদের কাছ থেকে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন গোয়েন্দারা।
নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন ওই ছদ্মবেশ ধারণ করে পুলিশ বা আধা সামরিক বাহিনী কিংবা কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীর উপর মাওবাদীরা হামলা চালাতে পারে বলে গোয়েন্দাদের আশঙ্কা। বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের দুমকায় মাওবাদী হামলায় ভোট-ফেরত পাঁচ পুলিশ-সহ আট জন নিহত হওয়ার পর এই ব্যাপারে আরও তটস্থ এই রাজ্যের পুলিশ।
রাজ্য গোয়েন্দা শাখার (আইবি) এক শীর্ষকর্তা বলেন, “নিরাপত্তার ঘেরাটোপকে ফাঁকি দিতে মাওবাদীরা অনেক সময়েই অভিনব কায়দায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা নেয়। আমাদের খবর অনুযায়ী, ওরা এ বার পুলিশ বা আধা সামরিক বাহিনীর ছদ্মবেশে পশ্চিমবঙ্গে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে।”
পুলিশের ছদ্মবেশে কী ধরনের হামলা চালাতে পারে মাওবাদীরা?
গোয়েন্দারা মনে করছেন, ছদ্মবেশী মাওবাদীদের দলটি ইউনিফমের্র সুযোগ নিয়ে পুলিশের অন্য কোনও দলের কাছাকাছি গিয়ে তাদের উপর গুলি চালাতে পারে। আবার একই ভাবে কোনও ভিআইপি বা রাজনৈতিক নেতা কিংবা নেত্রীকে ‘টাগের্ট’ করতে পারে তারা। তবে এক গোয়েন্দা অফিসারের মতে, গুলি চালিয়ে হামলা করার পরে মাওবাদীদের পক্ষে তল্লাট ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শক্ত। বিশেষ করে এখন যেখানে তাদের জনসমর্থন তেমন নেই। তার চেয়ে পুলিশের দল সেজে কোনও এলাকায় ঢুকে সেখানে ল্যান্ডমাইন পুঁতে এবং তার টেনে বিস্ফোরণ ঘটানো সহজ বলে ওই অফিসার মনে করছেন।
পুলিশ সাজা মাওবাদীদের হামলা ঠেকাতে পুলিশ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?
অন্যান্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি গোয়েন্দারা পরামর্শ দিয়েছেন, ভোটের ডিউটি বা ভিআইপি-ডিউটির সময়ে শুধু সাদা পোশাকে থাকা রক্ষী বা অফিসারেরাই নন, ইউনিফর্মে থাকা অফিসার ও নিরাপত্তারক্ষীদেরও প্রত্যেকে যেন নিজেদের সচিত্র পরিচয়পত্র পোশাকের উপর সেঁটে রাখেন। এমনিতে ইউনিফর্ম পরা নিরাপত্তারক্ষীরা পুলিশ বা আধা সামরিক বাহিনীর বিশেষ চিহ্ন বা হলোগ্রাম সম্বলিত কার্ড পোশাকের উপর ঝুলিয়ে রাখেন, কিন্তু তাঁদের জন্যও সচিত্র পরিচয়পত্রের কথা এ-ই প্রথম এই রাজ্যে বলা হল বলে গোয়েন্দাদের বক্তব্য।
তবে এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, “পুলিশের সচিত্র পরিচয়পত্রও তৈরি করে নেওয়া মাওবাদীদের পক্ষে সমস্যার কিছু নয়।”
গ্রেফতার করার ছলে পুলিশের পোশাক পরা দুষ্কৃতীরা কাউকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে, বলিউডের ছবিতে এ রকম উদাহরণ আছে আকছার। এই ধরনের কয়েকটি ছবির ক্লাইম্যাক্সে আছে ছদ্মবেশী পুলিশরূপী খলনায়ক আর আসল পুলিশের ভূমিকায় থাকা নায়কের লড়াই। তবে সেলুলয়েডের পর্দায় নয়, বাস্তবে পুলিশের ছদ্মবেশ ধরা মাওবাদীদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের দুই রাজনৈতিক নেতা। ওই দু’টি ঘটনা নয়ের দশকের শেষ দিকের।
তবে গত বছর অক্টোবরে ছত্তীসগঢ়ের দন্তেবাড়ায় স্কুলের পোশাকে পড়ুয়ার ছদ্মবেশধারী মাওবাদীরা এক পুলিশ কনস্টেবলকে খুন করেছিল। আবার ২০১০-এর সেপ্টেম্বরে ঝাড়গ্রামের শিলদায় স্কুলপড়ুয়াদের পোশাক পরে স্কুলে ঢুকে সেখানকার কর্মী এক সিপিএম নেতাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিল মাওবাদীরা। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য পুলিশ, সিআরপি-র ছদ্মবেশে মাওবাদীরা এখনও হামলা চালায়নি।
কিন্তু এ বার লোকসভা ভোট চলাকালীন সেই রকম হামলার আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলমহলের পাশাপাশি বীরভূমেও মাওবাদীরা নাশকতা ঘটাতে পারে। বীরভূমের ন’টি থানা এলাকাকে মাওবাদী প্রভাবিত বলে রাজ্য সরকার চিহ্নিত করেছে। বৃহস্পতিবার দুমকার যে জায়গায় মাওবাদী হামলায় আট জন নিহত হয়েছেন, সেই শিকারিপাড়ার দূরত্ব বীরভূমের রামপুরহাট থেকে ৪০ কিলোমিটারেরও কম।
২০১০-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি মাওবাদীরা শিলদার ইএফআর শিবিরে হামলা চালিয়ে ২৪ জন জওয়ানকে হত্যা করার পাশাপাশি তাঁদের প্রায় ৪০টি ইউনিফর্ম শিবির থেকে লুঠ করে নিয়েছিল। শিলদার ওই শিবির থেকে লুঠ হওয়া বেশ কয়েকটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল পর্যায়ক্রমে পুলিশ উদ্ধার করলেও ইএফআর জওয়ানদের ওই সব পোশাকের বেশির ভাগের খোঁজ কিন্তু মেলেনি। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, মাওবাদীদের সম্ভাব্য হামলায় ব্যবহার করা হতে পারে ইএফআর জওয়ানদের ওই সব পোশাক।
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ অফিসার বলেন, “শুধু শিলদার ইএফআর জওয়ানদের ইউনিফর্ম নয়, প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশায় মাওবাদীরা পুলিশ ও সিআরপি-র অনেক পোশাক লুঠ করেছে। সেখান থেকে মাওবাদীদের হামলাকারী দল ওই সব পোশাক পরে এ রাজ্যে ঢুকতে পারে।”
কাজেই, এই রাজ্যে মাওবাদী কার্যকলাপ আপাত দৃষ্টিতে বন্ধ থাকলেও ভোটের মুখে অতি বাম বিপ্লবীদের নিয়ে স্বস্তিতে নেই পুলিশ।