মঙ্গলবার রাতে যে ভাবে তাড়াহুড়ো করে সল্টলেকের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সুদীপ্ত সেন ও তাঁর স্ত্রী পিয়ালি সেনের নামে থাকা লকার খুলেছে বিধাননগর পুলিশ, তাতে ক্ষুব্ধ এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। বুধবার ইডি-র অধিকর্তা (পূর্বাঞ্চল) যোগেশ গুপ্ত বলেন, “এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সারদা-কর্তার গ্রেফতারের পরে প্রায় এক বছর ধরে লকারটি বিধাননগর পুলিশের এক্তিয়ারে থাকলেও তারা সেটি খোলার কোনও উদ্যোগ নেয়নি। গত ১৯ এপ্রিল ইডি ওই লকারের খোঁজ পেয়ে সেটি খুলতে গেলে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তাদের জানায়, লকারটি রাজ্য পুলিশের এক্তিয়ারে। ইডি লকারের খোঁজ পেয়েছে জানার পরেই নড়েচড়ে বসে বিধাননগরের গোয়েন্দা পুলিশ। সোমবার আদালতের কাছে তারা লকারটি খোলার অনুমতি চায়। মঙ্গলবার দুপুরে সেই অনুমতি পেয়ে রাতেই লকারটি খোলে তারা। তার আগে অবশ্য ইডি-কে চিঠি লিখে সেই খবর জানিয়ে দেয় তারা।
কিন্তু ইডি লকারটি বাজেয়াপ্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে জানার পরেই সেটি রাতারাতি খোলা হল কেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অভিযোগ, ওই লকারটি যাতে ইডি-র হাতে না পড়ে সে জন্যই তড়িঘড়ি সেটি খুলে তার ভিতরে থাকা জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করেছে রাজ্য পুলিশ। তাদের বক্তব্য, প্রায় এক বছর ধরে রাজ্য পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। কিন্তু তারা সুদীপ্তের স্ত্রী পিয়ালি বা ছেলে শুভজিৎকে গ্রেফতার করেনি। যদিও প্রভিডেন্ড ফান্ড দফতরের মামলায় প্রথম চার্জশিটে পিয়ালির নাম ছিল। কিন্তু পুলিশ পরে অতিরিক্ত চার্জশিট পেশ করে তাঁর নাম অভিযুক্তদের তালিকা থেকে বাদ দেয়। এক বছর তদন্ত চললেও ওই লকারটি খোলারও কোনও চেষ্টা তারা করেনি।
এই অভিযোগ অবশ্য মানতে চায়নি বিধাননগর পুলিশ। সারদা কাণ্ডের তদন্তের দায়িত্বে থাকা সল্টলেকের গোয়েন্দাপ্রধান অর্ণব ঘোষ গত কয়েক মাস ধরে এই তদন্তের ব্যাপারে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়া ছেড়েই দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার লকার কাণ্ডের পরে বুধবার তিনি নিজেই তড়িঘড়ি সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, ইডি-র তদন্তে বাধা দিতে নয়, বরং তাদের সাহায্য করার জন্যই পুলিশ লকারটি খুলেছে।
কী ধরনের সাহায্য, এই প্রশ্নের অবশ্য স্পষ্ট কোনও জবাব অর্ণববাবু দেননি। তিনি বলেন, “আমরা লকারটি খুলে যা যা পেয়েছি, তা তো ইডি আদালতের অনুমতি নিয়ে আমাদের কাছ থেকে জানতেই পারে। এতে অসুবিধা কোথায়?” তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, ইডি লকার খুললেও তো পুলিশ একই ভাবে তার ভিতরে কী আছে তা জানতে পারত? তা হলে তারা সাত তাড়াতাড়ি লকারটি খুলতে গেল কেন? অর্ণববাবুর জবাব, “লকারটি আমাদের হেফাজতে ছিল। তাই আমরা খুলেছি।”
কী মিলেছে সল্টলেকের বিডি ব্লকে অবস্থিত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ওই লকার থেকে?
বিধাননগর পুলিশের দাবি, লকার থেকে হিরের কানের দুল, রুপোর মুদ্রা ও সোনার হার-বালা পাওয়া গিয়েছে। কোনও নথি পাওয়া যায়নি। এই গয়নাগাঁটির সঙ্গে সারদার টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলার কী সম্পর্ক? এর উত্তরে অর্ণববাবু বলেন, “এত তাড়াতাড়ি সে কথা বলার সময় আসেনি।” এই লকারের অন্যতম মালকিন পিয়ালি সেনকেও গ্রেফতার করার প্রয়োজন বোধ করেননি তিনি।
ইডি সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, ওই লকারের মধ্যে সারদার বিভিন্ন সম্পত্তির নথি পাওয়া যেতে পারে, এমনটাই তাদের ধারণা ছিল। কারণ, ইডির তদন্তে ইতিমধ্যেই বেনামে থাকা জমি, পানশালা-সহ সারদার প্রায় ১০০ কোটি টাকার সম্পত্তির হদিস মিলেছে। এমন আরও কিছু সম্পত্তির হদিশ ওই লকার থেকে মিলতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সুদীপ্ত-ঘনিষ্ঠরা। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ওই লকারটি তল্লাশি করতে চাওয়া হয়েছিল বলে ইডি সূত্রের দাবি। ফলে বিধাননগর পুলিশের দেওয়া তালিকা সম্পর্কে সন্দিহান ইডি গোয়েন্দাদের একাংশ। যদিও বিধাননগর পুলিশের পাল্টা দাবি, আদালতের নির্দেশে লকার তল্লাশির পুরো পর্বটাই ভিডিও রেকর্ডিং করে রাখা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতের ঘটনার পর এ দিনও ইডি সারদা কাণ্ডে নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। ইডির একটি সূত্র জানাচ্ছে, এর পরে তদন্তের অগ্রগতি কী হতে পারে, সে ব্যাপারে অফিসারদের সঙ্গে এ দিন বৈঠকে বসেছিলেন যোগেশ গুপ্ত। সেখানে ভবিষ্যতের তদন্ত পদ্ধতি নিয়ে বেশ কিছু নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
ইডি সূত্রের খবর, সারদার সংবাদ মাধ্যমের ব্যবসা নিয়ে খোঁজখবর শুরু করা হয়েছে। এ নিয়ে সারদার একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক ও তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ আহমেদ হাসানকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। ওই কাগজটি এখনও কী ভাবে চলছে, সে ব্যাপারে ওই সাংসদের কাছে জানতে চাওয়া হবে। ডেকে পাঠানোর কথা স্বীকার করে আহমেদ জানান, এ ব্যাপারে তিনি ইডি-কে বিস্তারিত জানাবেন।
এ দিনই সারদার সংবাদমাধ্যম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এক ব্যবসায়ীকে নিজেদের দফতরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ইডি অফিসারেরা। ইডি সূত্রের খবর, সুদীপ্ত সেন একটি কাগজ ও চ্যানেল কেনার ব্যাপারে দুই ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। অগ্রিম কয়েক লক্ষ টাকা দেওয়াও হয়েছিল। সে সময় এই ব্যবসায়ী মধ্যস্থতা করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে। “এ ব্যাপারেই বিশদ জানতে ওই ব্যবসায়ীকে জেরা করা হয়েছে।”বলছেন ইডি-র এক তদন্তকারী।