স্কুল সার্ভিস কমিশনে নিজের ঘরে ঢুকতে নকল চাবি তৈরি করাচ্ছেন অমিতেশ বিশ্বাস। মঙ্গলবার শৌভিক দে-র তোলা ছবি।
স্কুল সার্ভিস কমিশন বা এসএসসি-র সহ-সচিবের পদ থেকে অমিতেশ বিশ্বাসকে বদলি বা ‘রিলিজ’ করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল বলে সরকারি মহলের অভিমত। অমিতেশবাবুরও বক্তব্য সেটাই। সেই জন্য মঙ্গলবার তিনি কমিশনে গিয়ে নকল চাবি তৈরি করিয়ে নিজের ঘরে ঢোকেন। পরে নবান্নে মুখ্যসচিব এবং অন্যদের সঙ্গে বৈঠকও করেন। তাঁকে ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ পাঠানো হচ্ছে বলে স্বরাষ্ট্র কর্মিবর্গ দফতর সূত্রের খবর।
মঙ্গলবার সারা দিনে অমিতেশবাবুকে ঘিরে সল্টলেকে এসএসসি-র সদর দফতর এবং নবান্নে বিস্তর নাটক হয়ে যায়। সেই নাটকের দৃশ্য অনেক। সদর দফতরে ঢুকতে অমিতেশবাবুকে বাধা দেওয়া। তাঁকে ঘিরে কর্মী-বিক্ষোভ। নকল চাবি তৈরি করিয়ে তাঁর ঘরে ঢোকা। তাঁর নামে পুলিশের কাছে কমিশন-কর্তৃপক্ষের অভিযোগ দায়ের করা। এসএসসি-র দফতরের সামনে ১৪৪ ধারা জারি করা। শেষ পর্যন্ত তাঁকে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠানোর তোড়জোড়। সব মিলিয়ে বিতর্ক এ দিন আরও জটিল আকার নেয়। এসএসসি-র পরীক্ষা ও সুপারিশের পদ্ধতি নিয়ে অমিতেশবাবুর অভিযোগ এবং নকল চাবি দিয়ে তাঁর ঘরে ঢোকার ঘটনার নিন্দা করেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু।
২০১২-র এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে দুর্নীতির সোমবার সংবাদমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন অমিতেশবাবু। ওই দিনই সন্ধ্যায় প্রকাশ্যে আসে দফতর থেকে তাঁকে রিলিজ করার নির্দেশ। কিন্তু অমিতেশবাবুর দাবি, চেয়ারম্যান এ ভাবে তাঁকে রিলিজ করতে পারেনই না। তার জন্য কর্মিবর্গের দফতর (তিনি আসলে যে-দফতরের কর্মী) থেকে নির্দেশ আসা দরকার। সেটি না-পাওয়ায় তিনি চেয়ারম্যানের রিলিজ-নির্দেশ দেওয়া চিঠি নিতে অস্বীকার করেন। চিঠির পাশাপাশি এই বিষয়ে তাঁকে যে একটি ই-মেলও পাঠানো হয়েছে, তা স্বীকার করেন অমিতেশবাবু।
সহ-সচিবকে রিলিজের নির্দেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সরকারি মহলেও। সরকারি সূত্রের খবর, অমিতেশবাবু ডব্লিউবিসিএস অফিসার। তাই তাঁর ব্যাপারে কর্মিবর্গ দফতরই রিলিজের নির্দেশ জারি করতে পারে। তা হলে কীসের ভিত্তিতে অমিতেশবাবুকে তিনি আচমকা রিলিজ করার নির্দেশ দিলেন, এসএসসি-র চেয়ারম্যানের কাছে সেই প্রশ্নের সদুত্তর নেই। তবে তাঁর এই রিলিজের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়ে গিয়েছে, প্রশাসনিক মহল তা মেনে নিচ্ছে।
বিতর্কিত ‘রিলিজ’ পাওয়ার এক দিন পরে, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ অমিতেশবাবু সল্টলেকে কমিশনের সদর দফতরে ঢুকতে গেলে রক্ষীরা জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাঁর ঢোকার অনুমতি নেই। তিনি রক্ষীদের বুঝিয়েসুজিয়ে তেতলায় নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে জানতে পারেন, চেয়ারম্যানের নির্দেশ অনুযায়ী তাঁকে চাবি দেওয়া যাবে না। তিনি নিজের গাড়ির চালককে পাঠিয়ে এক চাবির কারিগরকে ডাকিয়ে আনেন। পরে কারিগরের তৈরি করা নকল চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢোকেন। কিছু পরে চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কমিশনের এক শ্রেণির কর্মীর রোষের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। ওই কর্মীরা স্লোগান দেন, ‘অমিতেশ হটাও, কমিশন বাঁচাও’।
সুবীরেশবাবু জানান, দুর্ব্যবহার, এফআইআর করা ও খুনের হুমকি দেওয়া, মহিলাদের সঙ্গে অভব্য আচরণ ইত্যাদি অভিযোগে ১২ মার্চ অমিতেশবাবুর বিরুদ্ধে তাঁকে চিঠি দেন কমিশনের কর্মীরা। চেয়ারম্যান ১৮ মার্চ কর্মিবর্গের দফতরে চিঠি পাঠিয়ে অমিতেশবাবুর আচরণ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
সুবীরেশবাবু বলেন, “ওই চিঠিতে জানিয়েছি, অমিতেশবাবুর বদলে অন্য কোনও যোগ্য ব্যক্তিকে সহ-সচিব হিসেবে পাঠানো হোক।” এই সব তথ্য দিয়ে সুবীরেশবাবু দাবি করেন, সোমবার সংবাদমাধ্যমে মুখ খোলার জন্য অমিতেশবাবুকে রিলিজ করা হয়নি। আগে থেকেই অমিতেশবাবুর কাজে সমস্যা হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে কমিশন।
রিলিজ করে দেওয়ার পরেও অমিতেশবাবু জোর করে সহ-সচিবের ঘরে ঢুকেছেন, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করেছেন এবং রক্ষীকে মেরেছেন বলে এ দিন বিধাননগর কমিশনারেটের কাছে অভিযোগ জানান সুবীরেশবাবু। দুপুরে কমিশনে গিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন বিধাননগর পূর্ব থানার ওসি শেখর রায়। বিকেলেই এসএসসি-র দফতরে ১৪৪ ধারা জারির কথা ঘোষণা করে পুলিশ। ৮ জুন পর্যন্ত তা জারি থাকবে।
অমিতেশবাবুর মূল অভিযোগ, অনেক চাকরিপ্রার্থীকে বঞ্চিত করে তুলনায় অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে কমিশন। চেয়ারম্যানকে তা বারবার জানিয়েও লাভ হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, সোমবার সংবাদমাধ্যমের কাছে কমিশনের দুর্নীতি নিয়ে মুখ খোলার আগে তিনি সরকারের উচ্চ স্তরে অভিযোগ জানালেন না কেন? আগে তো বিভিন্ন সময়ে কমিশনের সাংবাদিক বৈঠকে চেয়ারম্যানের সঙ্গেই দেখা গিয়েছে তাঁকে। এখন কমিশনের ভিতরে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমছে বলেই কি অমিতেশবাবু প্রকাশ্যে মুখ খুললেন?
অমিতেশবাবু বলেন, “আমি নিয়ম অনুযায়ী চেয়ারম্যানকে টপকে সরকারি কোনও স্তরে মুখ খুলতে পারি না।”
তা হলে আদালত বা পুলিশের দ্বারস্থ না-হয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে অভিযোগ জানালেন কেন? উত্তর নেই অমিতেশবাবুর কাছে।
অমিতেশবাবুর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই কমিশনের আইনজীবীরা মামলা লড়েছেন বলে জানান চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “তখন তো উনি পরীক্ষার বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। আমার কাছেও তথ্য সংবলিত কোনও অভিযোগ জানাননি। ওঁকে অনুরোধ জানাচ্ছি, যথাযথ তথ্য দিয়ে অভিযোগ জানান। তদন্ত হবে। সত্য প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেব। নইলে ওঁর বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির দাবি জানানো হবে।” সুবীরেশবাবুর কথায়, “চাকরিপ্রার্থীরা যখন অনশন-আন্দোলন করছিলেন, তখন তো অমিতেশবাবুই তাঁদের মাওবাদী বলেন। অনশন মঞ্চের আলো কেটে দেন। তখন ওঁর এই দরদি ভাবমূর্তি দেখা যায়নি!”
এ-সব বিষয়ে অমিতেশবাবু কোনও মন্তব্য করেননি। তবে তাঁর দাবি, পরীক্ষা, ফলপ্রকাশ, চাকরিতে সুপারিশের পদ্ধতির সঙ্গে তাঁকে কখনও যুক্ত করাই হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে আদালতে কমিশনের আইনজীবীর সঙ্গে তিনি উপস্থিত ছিলেন কেন? এমনকী আদালতের নিয়ম ভেঙে আইনজীবীকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য তাঁকে কক্ষ থেকে বার করেও দেওয়া হয়। পরীক্ষা পদ্ধতিতে যুক্ত না-থেকেও মামলার সময় তাঁর এই উপস্থিতির কারণ কী? উত্তর দিতে পারেননি অমিতেশবাবু।
এ দিন বেলা সাড়ে ৩টে নাগাদ কমিশনের দফতর থেকে বেরিয়ে নবান্নে যান অমিতেশবাবু। নবান্ন সূত্রের খবর, মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের সঙ্গে তিনি দেখা করেন। কর্মিবর্গ দফতরের অফিসারদের সঙ্গেও দীর্ঘ বৈঠক করেন। কর্মিবর্গ দফতর সূত্রের খবর, তাঁকে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠানো হচ্ছে। যদিও অমিতেশবাবু এ ব্যাপারে কোনও কথা বলতে চাননি। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ নবান্ন থেকে বেরোন তিনি। কড়া পুলিশি প্রহরায় তাঁকে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়।
এ দিন বালুরঘাটে একটি কর্মিসভায় শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্যবাবু বলেন, “অমিতেশবাবু যা বলেছেন, তার সবটাই যে মিথ্যা, ইতিমধ্যে তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আপাতত সব সমস্যা মিটে গিয়েছে। তবে তিনি এ দিন তালা ভেঙে দফতরে ঢুকে ভুল কাজ করেছেন।” সেই সঙ্গেই মন্ত্রীর বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও দিন দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি। ভবিষ্যতেও দেবেন না। নির্বাচনের আগে রাজ্য সরকারকে বদনাম করতে অনেকে অনেক কিছুই বলবেন।
এমনিতেই আদালতের রায়ে এ বছরের এসএসসি-র পরীক্ষা থমকে আছে। ২০১২-র পরীক্ষা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের সাধারণ বদলির প্রক্রিয়া শুরুর আগেই স্থগিত করে দিয়েছে কমিশন। তার উপরে এসএসসি-র কর্তাদের এই কাজিয়া।
এর জেরে এসএসসি-র মতো চাকরির সুপারিশকারী একটি সংস্থার জরুরি কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।