বিমান পরিষেবা ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। রেলমন্ত্রীও একই পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সংস্কারের সেই পথ ধরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঠিক করেছে, খোলা বাজারে জ্বালানি-দরের ওঠা-পড়ার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে রাজ্যে বাসভাড়াও বাড়বে-কমবে।
রাজ্য সরকারি পরিবহণ নিগমগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য ফেরাতে সম্প্রতি কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) যে রিপোর্ট দিয়েছে নবান্নকে, সেখানেই এমন সুপারিশ করা হয়েছে। ভর্তুকিনির্ভর, রুগ্ণ সরকারি পরিবহণের হাল ফেরাতে সিএজি-র আরও প্রস্তাব: চল্লিশোর্ধ্ব কর্মীদের জন্যও স্বেচ্ছাবসর প্রকল্প চালু করা হোক। দু’টো প্রস্তাবেই সরকারি সিলমোহর পড়তে চলেছে বলে নবান্ন-সূত্রের খবর।
বহু কোটি টাকা লোকসানের ভারে ন্যূব্জ পরিবহণ নিগমগুলো কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সিএজি’কে তা খতিয়ে দেখতে বলেছিল পরিবহণ দফতর। গত গত মাসে এ নিয়ে সরকার-সিএজি আলোচনা হয়। নবান্নের খবর: বৈঠকে সিএজি’র পরামর্শে পরিবহণ-কর্তারা সায় দিয়েছেন। সব ঠিকঠাক চললে আগামী পয়লা বৈশাখ (১৫ এপ্রিল) থেকে ডিজেলের দাম ওঠা-নামার সঙ্গে বাসভাড়াকে জুুড়ে দেওয়া হবে বলে দফতর-সূত্রের ইঙ্গিত। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, শুধু সরকারি পরিবহণের কথা মাথায় রেখে সিএজি এই সুপারিশ করলেও বেসরকারি বাসের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রেও রাজ্য সরকার একই ব্যবস্থা চালু করতে আগ্রহী। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত মিলেছে। একটি ‘টাস্ক ফোর্স’ কাজও শুরু করেছে।
পরিবহণ-কর্তাদের আশা, পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে অনেক সমস্যা এড়ানো সম্ভব। “সংস্কারও হবে। আবার তেলের দাম বাড়লেই ভাড়া বাড়ানোর যে দাবি ওঠে, তা থেকে নিস্তার মিলবে।” মন্তব্য এক আধিকারিকের। যা শুনে বেসরকারি মালিকেরা অবশ্য এখনই খুব আশান্বিত হতে পারছেন না। ওঁদের বক্তব্য: পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকাটা সবচেয়ে জরুরি। বেসরকারি বাস-মালিকদের অন্যতম সংগঠন ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটস’-এর নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “বাসভাড়া শুধু ডিজেলের দরের উপরে নির্ভর করে না। পার্টসের দাম, অন্যান্য খরচ-খরচাও মাথায় রাখতে হবে। তেলের দাম কমলেই আগু-পিছু বিবেচনা না-করে ভাড়া কমিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় এসেই জানিয়ে দিয়েছিল, বাসভাড়া বাড়ানো হবে না। বস্তুতই মমতা জমানার গত তিন বছরে বেশ ক’দফায় ডিজেলের দাম বাড়লেও মুখ্যমন্ত্রী বাসভাড়া বৃদ্ধির দাবিকে আমল দেননি। বাড়তি খরচ পোষাতে না-পেরে বহু মালিক যেমন বাস বসিয়ে দিয়েছেন, তেমন সরকারি পরিবহণ নিগমগুলোর হালও তথৈবচ। তাদের বোঝার ভার বাড়িয়েছে বাড়তি কর্মীর চাপ। অর্থাভাবে বিভিন্ন নিগমের বিস্তর বাস রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না। যে ক’টা চলছে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তারও সিংহভাগ লজ্ঝরে।
জেএনএনইউআরএমের নতুন কিছু বাস রাস্তায় নেমেছে বটে, তবে তা দিয়ে সব রুটে যাত্রীর চাপ সামাল দেওয়া মুশকিল। সব মিলিয়ে আমজনতার ভোগান্তির একশেষ। রাস্তায় বেরিয়ে বাস না-পেয়ে বহু নিত্যযাত্রীকে রিকশা-অটো-ট্যাক্সি-মেট্রো ইত্যাদিতে যাত্রাপথ ভেঙে-ভেঙে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে। পকেট থেকে খসছে বেশি। হিসেব কষে অনেকে দেখেছেন, বাসে উঠে বাড়তি ভাড়া গুণতে হলেও খরচ তুলনায় কম হতো, ঝক্কিও এত পোহাতে হতো না।
শেষমেশ বহু আন্দোলন-প্রতিবাদ-বিক্ষোভের জেরে ক’মাস আগে সরকার স্টেজপিছু ১ টাকা হারে বাসভাড়া বাড়ায়। যদিও বেসরকারি মালিকেরা তাতে একেবারেই সন্তুষ্ট নন। ওঁদের দাবি, এত দিন জ্বালানি-যন্ত্রাংশের দাম উত্তরোত্তর বাড়লেও বাস চালিয়ে তাঁরা যে লোকসান পুইয়েছেন, এই বৃদ্ধি তার তুলনায় কিছুই নয়। এবং খুব সম্প্রতি ছ’দফায় তেলের দাম কমলেও ওঁরা ভাড়া কমানোর ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করেননি, যাতে আবার আমজনতার মনে প্রশ্ন জাগছে। এমতাবস্থায় সিএজি-র সুপারিশকে সামনে রেখে সুরাহা খুঁজতে তৎপর হয়েছে সরকার। সিএজি কী বলছে?
সিএজি’র এক মুখপাত্রের ব্যাখ্যা: ভর্তুকি আর ঋণের চাপে রাজ্যের কোষাগার শুকিয়ে গিয়েছে। পুজোর পর থেকে সরকারের কার্যত দিন-আনি-দিন-খাই দশা। এ দিকে চলতি বছরের রাজ্য বাজেটেও বিবিধ ক্ষেত্রে মোট ২২৪০ কোটি টাকা ভর্তুকির দায়, যার মধ্যে পাঁচশো কোটি-ই বরাদ্দ সরকারি পাঁচ পরিবহণ নিগমের (সিএসটিসি, এনবিএসটিসি, এসবিএসটিসি, ডব্লিুউবিএসটিসি এবং সিটিসি) জন্য। সরকার নানা ভাবে এই বোঝা ঘাড় থেকে নামানোর চেষ্টা করেও সফল হয়নি। পাঁচটিকে মিশিয়ে একটাই সরকারি পরিবহণ নিগম গঠনের প্রস্তাব কার্যকর করা যায়নি। ভর্তুকি হ্রাসের পথ খুঁজতে মুুখ্যমন্ত্রী যে মন্ত্রিগোষ্ঠী গড়ে দিয়েছিলেন, তার নানাবিধ প্রস্তাবও বাস্তবায়িত হয়নি। এই পরিস্থিতিতে পাঁচ নিগমের লোকসান কমিয়ে বাড়তি আয়ের পথ বাতলাতে সিএজি-কে আবেদন জানিয়েছিল রাজ্য। সেই প্রেক্ষাপটেই সিএজি’র সংস্কার-প্রস্তাব। কী রকম?
দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পরিবহণ সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ যে সমস্ত সংস্কার-পদক্ষেপের উল্লেখ করেছে, তাতেই বলা হয়েছে, ভাড়া নির্ধারণের ভার সরকারের হাতে না-রেখে স্বাধীন কমিটিকে দেওয়া হোক। তারই সূত্রে সিএজি পশ্চিমবঙ্গে সরকারি বাসের জন্য ‘অটোম্যাটিক ফেয়ার রিভিশন কমিটি’ গড়ার কথা বলেছে। যার অর্থ, তেলের দাম বাড়লে-কমলে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি বাসের ভাড়া ঠিক করবে ওই কমিটি। নিগম-কর্তারা প্রস্তাবটি মেনে নিয়েছেন।
একই সঙ্গে সিএজি চাইছে, সরকারি পরিবহণ নিগমে কর্মরত চল্লিশ বছরের বেশি বয়সীদেরও স্বেচ্ছাবসর প্রকল্পের আওতায় আনা হোক। এতে অতিরিক্ত কর্মীর বোঝা কমবে। তথ্য বলছে, নিগমগুলোয় এই মুহূর্তে বাসপিছু গড়ে ১০-১১ জন কর্মী বহাল, যেখানে ৪-৫ জনই যথেষ্ট। এত বাড়তি কর্মীর সুবাদেও ভর্তুকিতে রাশ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে কর্মীমহলের একাংশের প্রশ্ন, যেখানে সরকারি চাকরিতে যোগদানেরই সর্বোচ্চ বয়স ৪০, সেখানে চল্লিশোর্ধ্বদের স্বেচ্ছাবসর কতটা বাস্তবোচিত?
পাশাপাশি প্রতিটি নিগমের রুট-এলাকা বেঁধে দেওয়ার সুপারিশ করেছে সিএজি। বাস চলাচলের খতিয়ান, কর্মচারীদের কাজের ফিরিস্তি ও টিকিট বিক্রির অঙ্ক সফ্টওয়্যার মারফত নথিভুক্তিকরণ, কর্মীদের আধুনিক পরিবহণ-পরিষেবার প্রশিক্ষণ ইত্যাদিতেও জোর দিয়েছে। সিএজি’র ইকনমিক অ্যান্ড রেভেনিউ সেক্টর অডিট বিভাগের অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল (এজি) মৌসুমি রায় ভট্টাচার্য গত ২০ নভেম্বর পরিবহণ-কর্তাদের সঙ্গে আয়োজিত বৈঠকে সুপারিশগুলি নিয়ে আলোচনা করেন। বৈঠকে রাজ্যের পরিবহণ কমিশনার-সহ পাঁচ নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টরেরা ছিলেন। দীর্ঘ আলোচনা শেষে সংস্কার-কর্মসূচি নিয়ে উভয়পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছায়।
এজি মৌসুমিদেবী ২৭ নভেম্বর রাজ্যের পরিবহণ-সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে সুপারিশ রূপায়ণে উদ্যোগী হতে বলেছেন। আলাপনবাবুর কথায়, “জ্বালানির হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় রেখে ভাড়া কমানো-বাড়ানোর বিষয়ে সরকার কাজ শুরু করে দিয়েছে। আগামী দু’তিন মাসের মধ্যে এই সংক্রান্ত নীতি ঘোষণা করা হবে।”
এজি-র অন্যান্য পরামর্শ সম্পর্কেও সরকার যথাসময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন সচিব।