সংসদে বিক্ষোভ দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের চিঁড়ে ভিজবে না আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে রাজ্যের শাসক দলকে সতর্ক করে বললেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের জমি নীতির সমালোচনা করে জেটলির প্রশ্ন, “জমি অধিগ্রহণের ছাড়পত্র দেব না, আর শিল্পপতিকে বলব শিল্প করো। এটা কী করে হয়?” রাজ্য সরকার তার জমি ব্যাঙ্ক থেকে শিল্পের জন্য জমি দেওয়ার যে প্রস্তাব দিচ্ছে, তার বাস্তবতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। শিল্প মহলের সুরেই তিনি বলেছেন, সরকারের হাতে থাকা জমি আর শিল্পের চাহিদার মধ্যে আকাশপাতাল তফাত। অতএব, “কেন্দ্রের আনা জমি অর্ডিন্যান্স সমর্থন করলে আখেরে রাজ্যেরই লাভ।”
প্রশ্ন: সংসদে বিমা ও জমি বিলের বিরোধিতা করছে তৃণমূল। আপনি বলেছেন, এটা ধ্বংসাত্মক রাজনীতি। আপনারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সমালোচনা করছেন, আবার সহযোগিতার কথা বলছেন। এটা কী ভাবে সম্ভব?
• অরুণ জেটলি: কলকাতায় গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের কাছে আমি এই অনুরোধই জানাতে চাই যে, রাজ্যের স্বার্থেই জমি, বিমা ও কয়লা বিল সমর্থন করুন। জমি দিতে না-পারলে শিল্পপতিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে লাভ কী! রাজ্য সরকারের হাতে কত জমি আছে? আর পশ্চিমবঙ্গের শিল্প মানচিত্র বদলে দেওয়ার জন্য কত একর জমি প্রয়োজন? কয়লা বিল পাশ হলে রাজ্যের রাজস্ব আদায় বাড়বে। বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ এলে রাজ্যও তো তার সুবিধা পাবে। জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধন করে যে অর্ডিন্যান্স আনা হয়েছে, বিরোধী রাজ্যগুলি তার ফায়দা তুলতে না-পারলে উন্নয়নের দৌড়ে তারাই শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে পড়বে। বর্তমানের প্রতিযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে ওই রাজ্যগুলি কী ভাবে সুযোগ হারিয়েছিল, তার বিচার ইতিহাস করবে।
প্রশ্ন: কিন্তু রাজ্য সরকারের অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গকে আর্থিক সঙ্কট থেকে বের করতে কেন্দ্র কিছুই করছে না!
• রাজ্যের অর্থনৈতিক অধঃপতন গত পাঁচ মাসে হয়েছে এটা বললে তো শিশুও হাসবে। পশ্চিমবঙ্গ যে ঋণজর্জর রাজ্য, তা সর্বজন স্বীকৃত। অর্থ কমিশনও তাদের রিপোর্টে সে কথা জানিয়েছে। ব্রিটিশ যুগে বাংলা লুণ্ঠিত হয়েছে। ১৭৬৯ সালে লন্ডনে বসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকরা যে নীতি তৈরি করেছিলেন, ভারতীয় ইতিহাসবিদরা বলছেন, তাতে বাংলা আরও গুরুত্ব হারিয়েছিল। বিহার-সহ বাংলা আরও গ্রামে পরিণত হয়েছিল। আর ব্রিটেন হয়ে উঠেছিল আরও শিল্পোন্নত। চা, পাট শিল্পের বারোটা বেজে গিয়েছিল তখনই। এখানকার চাষিদের বাধ্য করা হয়েছিল নীল চাষে। স্বাধীনতা লাভের ঠিক দু’বছর পর ১৯৪৯ সালে দক্ষিণ কলকাতা বিধানসভার উপ নির্বাচনে শরৎচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি বিপজ্জনক। পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বই বিপন্ন।’ দিল্লিতে দীর্ঘ কংগ্রেস শাসনের পরেও পশ্চিমবঙ্গের সেই চালচিত্রে কোনও পরিবর্তন আসেনি। পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ বাম শাসনেও কেন্দ্র-বিরোধী স্লোগান শোনা গিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোনও পরিবর্তন হয়নি। রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ আশা করেছে এ বার অর্থনৈতিক পরিবর্তনও হবে। কিন্তু সেই পরিবর্তন কোথায়?
প্রশ্ন: মমতার অভিযোগ সিবিআই-কে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করছেন আপনারা! এই রাজনৈতিক উত্তাপে কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়সাধন কী ভাবে সম্ভব?
• সিবিআই তার নিজের কাজ করছে। যে হেতু সিবিআই তদন্ত চলছে এবং তা-ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে, তাই এ ব্যাপারে কোনও আলটপকা মন্তব্য করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন, সিবিআই তো বিভিন্ন রাজ্যে, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তদন্ত করছে। তার সঙ্গে রাজ্যের আর্থিক উন্নয়ন এবং শিল্পায়নের সম্পর্ক কী! নরেন্দ্র মোদীর সরকার যদি রাজনৈতিক ভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ হতো, তা হলে মমতার ডাকে সাড়া দিয়ে আমি বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে যাব কেন? অন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও অনেকেই কলকাতায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন এবং আরও অনেকে ভবিষ্যতে যাবেন। রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গেও আমার একাধিকবার কথা হয়েছে। সংসদে দাঁড়িয়েও বলেছি, অর্থ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের ঋণ পুনর্গঠনের ব্যাপারে কেন্দ্র বিবেচনা করবে। এ বিষয়ে (আমলা পর্যায়ের) পূর্বতন কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে কেন্দ্র-রাজ্য আলোচনায় সমস্যার সমাধান সম্ভব বলেও আশা করি।
প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সারদা কেলেঙ্কারি ও বাংলার তালিবানিকরণের ব্যাপারে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক!
• (প্রশ্ন থামিয়ে) কংগ্রেস এবং সিপিএম-কে রাজ্যের মানুষ দেখেছেন। তাদের ভূমিকায় রাজ্যবাসী বিরক্ত। এই মোহভঙ্গের মধ্যে বিজেপি যদি প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে চায় এবং শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রচার করে সেটা রাজ্য বিজেপির সাংগঠনিক কর্তব্য। দোহাই, এর সঙ্গে নর্থ ব্লক-সাউথ ব্লককে গুলিয়ে ফেলবেন না!
প্রশ্ন: আপনি আজ কলকাতা যাচ্ছেন। মমতার আমন্ত্রণে নৈশভোজেও যোগ দেবেন। কাল বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনেও আপনার থাকার কথা। কলকাতায় দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কি কোনও আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করবেন?
• প্যাকেজ ঘোষণা করাই আর্থিক সঙ্কট মোচনের একমাত্র পথ নয়। শিল্পনীতি, বিমা নীতি, কয়লা নীতি, জমি অধিগ্রহণ নীতি-সহ বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে সুস্থির সমন্বয়ের মাধ্যমেই দীর্ঘমেয়াদে রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট কাটার দরজা খুলতে পারে। পঞ্চাশের দশকে দেশে খাদ্যসঙ্কট তৈরি হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে ’৫৭ সালে কমিউনিস্টরা খাদ্য আন্দোলন করে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করলেও তাতে খাদ্য সঙ্কটের সমাধান হয়নি। অর্থনৈতিক সঙ্কটের পটভূমিতে যে কোনও রাজ্যেই হিংসা, সন্ত্রাসের ঘটনা বাড়ে। তাতে নতুন প্রজন্মের চাকরি হয় না। সংসদে তৃণমূলের বিক্ষোভের রাজনীতি তাদের সাময়িক কিছু সাফল্য দিতে পারে। কিন্তু তাতে রাজ্যের কী লাভ? আবার সিপিএম যে ভাবে তৃণমূলকে অনুসরণ করে বিক্ষোভের পথে গেল, তাতে তাদের বিচক্ষণতার অভাব দেখে বিস্মিত হয়েছি! সিপিএম-তৃণমূল আত্মীয়তা বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারের ভাল বিষয় হতে পারে। কিন্তু রাজ্যের উন্নয়ন করতে চাইলে উচিত কাজ হবে আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান করা। বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং কেন্দ্র বিরোধী বিবৃতি দিয়ে উন্নয়নের চিঁড়ে ভিজবে না।