জঙ্গলমহলের মন টানতে ফের কমিটি মাওবাদীদের

হিংসাত্মক কার্যকলাপ দু’বছর যাবৎ বন্ধ। প্রথমে বিধানসভা ও তার পর পঞ্চায়েতদু’টি নির্বাচনেই শাসকদলের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত। তবু এই আপাত নিস্তরঙ্গ জঙ্গলমহলে হারানো জনসমর্থনের ভিত পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে মাওবাদীরা অনেকটা নিঃশব্দেই নতুন এক গণ সংগঠন তৈরি করেছে বলে জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা। যার নাম ‘জঙ্গলমহল বাঁচাও কমিটি’।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৪ ০৩:২২
Share:

হিংসাত্মক কার্যকলাপ দু’বছর যাবৎ বন্ধ। প্রথমে বিধানসভা ও তার পর পঞ্চায়েতদু’টি নির্বাচনেই শাসকদলের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত। তবু এই আপাত নিস্তরঙ্গ জঙ্গলমহলে হারানো জনসমর্থনের ভিত পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে মাওবাদীরা অনেকটা নিঃশব্দেই নতুন এক গণ সংগঠন তৈরি করেছে বলে জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা। যার নাম ‘জঙ্গলমহল বাঁচাও কমিটি’।

Advertisement

২০০৮-এর নভেম্বরে লালগড়ে আদিবাসী মহিলাদের উপর পুলিশি অত্যাচারকে হাতিয়ার করে তৈরি হওয়া ‘পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি’ গড়ার পর এ-ই প্রথম মাওবাদীরা সরাসরি তৈরি করল নিজেদের গণ সংগঠন। এই ব্যাপারে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র দফতরে জমা পড়া গোয়েন্দা-রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও বলা হয়েছে, নতুন কমিটির বৈঠক করতে গিয়ে কয়েকটি গ্রামে প্রত্যাখ্যাতও হয়েছে মাওবাদীরা।

স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বাঁকুড়ার সারেঙ্গায় ওই কমিটি তৈরি হয়েছে এবং যার পিছনে মূল উদ্যোগ মাওবাদী শীর্ষনেতা বিকাশ ওরফে মনসারাম হেমব্রমের। প্রথমে বাঁকুড়ার তালড্যাংরার লাউতলা এবং ওন্দার ছাগুলিয়া গ্রামে ছোট ছোট বৈঠক, বাসিন্দাদের মধ্যে গোপনে প্রচারের মাধ্যমে কমিটির কাজ শুরু হয়। মার্চের মাঝামাঝি পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড়ের বুলানপুর গ্রামে নতুন কমিটির প্রথম সভায় যোগ দেন শ’চারেক মানুষ। যাঁদের অধিকাংশই আদিবাসী। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ ছাড়াও পুরুলিয়ার বান্দোয়ান, ঝাড়গ্রামের বিনপুর ও জামবনি এবং বাঁকুড়ার সারেঙ্গা, বারিকুল ও রানিবাঁধ এলাকা থেকে মানুষ ওই সভায় গিয়েছিলেন বলে গোয়েন্দা-রিপোর্টে বলা হয়েছে। সভায়বিকাশই বক্তব্য পেশ করেন বলে পুলিশের দাবি। বিকাশের গ্রাম চল্লাডাঙার দূরত্ব বুলানপুর থেকে বড়জোর পাঁচ কিলোমিটার। জঙ্গলপথে আরও কম।

Advertisement

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ২০০৮-এর ১২ নভেম্বর রাতে লালগড়ের দ্বারিগেড়িয়া গ্রামে বসে বিকাশ, শশধর মাহাতোর মতো মাওবাদী নেতারা ঠিক করেন, লালগড়ের আন্দোলনকে পরিচালনা করতে একটি কমিটির প্রয়োজন এবং ওই বৈঠকেই জনসাধারণের কমিটি নামটি চূড়ান্ত হয়। পর দিন বিকেলে দলিলপুর চকে এলাকার মানুষের সামনে ওই কমিটির নাম ঘোষণা করেন বিকাশ।

পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর অবশ্য ওই কমিটির নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ তৃণমূলে যোগ দেন। কিন্তু বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে কমিটির নেতা-কর্মীদের যে অংশ শাসকদলে যোগ দেননি, তাঁদের কয়েক জন ও জামিনে মুক্ত মাওবাদী স্কোয়াড-সদস্যদের বাছাই করা কয়েক জনকে নিয়ে নতুন কমিটি গড়া হয়েছে। যেমন, বাঁকুড়ার ওন্দার এক প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক ও তালড্যাংরায় ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টির এক নেতা নতুন কমিটিতে যোগ দিয়েছেন। মাওবাদী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে তিন বছর আগে তাঁদের ধরা হলেও বর্তমানে তাঁরা জামিনে মুক্ত।

গোয়েন্দাদের বক্তব্য, তিন বছরে জঙ্গলমহলে ‘সন্ত্রাস দুর্নীতি ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক মঞ্চ’, ‘জনগণের সমবায়’, ‘নারী ইজ্জত বাঁচাও কমিটি’-র মতো গণ সংগঠন হলেও সেগুলি ছিল মাওবাদী সমর্থক, সহানুভূতিসম্পন্নদের তৈরি। মাওবাদী নেতারা তাতে সরাসরি ছিলেন না।

কিন্তু লালগড়ের পুলিশি অত্যাচারের মতো কোনও উত্তপ্ত বিষয় যেখানে এখন অনুপস্থিত, সেখানে এই কমিটি তৈরি করার যৌক্তিকতা কোথায়? মাওবাদীদের একটি সূত্র জানাচ্ছে, পার্টি এখন জঙ্গলমহলে হারানো জনসমর্থন ফিরে পেতে মরিয়া। আবার লালগড় আন্দোলনের উত্তুঙ্গ পর্বে মাওবাদী সন্ত্রাসের বিষয়টি জনগণের মধ্যে যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তাতে এই মুহূর্তে পার্টির পক্ষে সরাসরি প্রচারে নামা ও কাজ করা মুশকিল। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করার জন্য একটি নতুন গণ সংগঠন প্রয়োজন, যার মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ-অসন্তোষগুলিকে তুলে ধরে আন্দোলনে নামা যায়। কারণ, জনসাধারণের কমিটির এক শ্রেণির নেতা-কর্মী এতটাই হিংসা ও অরাজকতা চালিয়েছে যে, ওই কমিটির উপরে মানুষ মোটের উপর বিরূপ। নতুন কমিটি তৈরির ব্যাপারে কিষেণজির ভাই তথা মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বেণুগোপাল প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন।

নয়া কমিটির আঁতুড়ঘর বাঁকুড়ায় সিপিএমের জেলা সম্পাদক তথা দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র বলেন, “মাওবাদীরা নতুন একটি গণ সংগঠন তৈরি করেছে বলে খবর পেয়েছি। তবে এর ভবিষ্যৎ কী, এখনই বলা সম্ভব নয়।”

কাঁটাপাহাড়িতে জনসাধারণের কমিটির এক পুরনো নেতার বক্তব্য, পঞ্চায়েত ভোটের ফলের নিরিখে জঙ্গলমহল কার্যত বিরোধীশূন্য। অথচ এক বছরেই বহু পঞ্চায়েতে তৃণমূলের দুর্নীতি, জুলুম, পুলিশ-প্রশাসনকে দিয়ে বিরোধীদের উপর অত্যাচার এ সব কারণে সাধারণ মানুষ বিরক্ত। তাঁর অভিযোগ, ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে ঘর পেতে তৃণমূল নেতাকে কমিশন দিতে হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত তোলা আদায় চলছে। তাঁর কথায়, “বিরোধীরা যখন এ সবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারছে না, তখন জঙ্গলমহলকে বাঁচাতে আমাদের এই কমিটি সেই ভূমিকা নেবে।”

তবে রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী ও ঝাড়গ্রামের তৃণমূল বিধায়ক সুকুমার হাঁসদার বক্তব্য, “কারা জঙ্গলমহলকে বাঁচানোর কথা বলছে? তাদের জন্যই তো জঙ্গলমহল রক্তাক্ত হয়েছিল আর সিপিএম উন্নয়নের কাজ না করায় পিছিয়ে পড়েছিল।” তৃণমূল সরকারের শাসনে জঙ্গলমহলে এখন শান্তি রয়েছে, উন্নয়ন হচ্ছে বলে মন্ত্রীর দাবি, “দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যে।” সুকুমারবাবু বলেন, “মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে মাওবাদীরা। মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করছেন।”

বস্তুত, গোয়ালতোড়ের বুলানপুর ছাড়া বিনপুরের তেঁতুলতলায় নতুন কমিটি সভা করতে পারলেও লালগড়ের আজনাশুলি, ডুমুরকোটা, শ্যামনগরের মতো গ্রামে বিকাশ ও তাঁর স্ত্রী তারা সদলে একাধিক বার গেলেও স্থানীয় মানুষের কাছে তাঁরা গুরুত্ব পাননি বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন। পুলিশি সূত্রের খবর, বেলপাহাড়ির শিমুলপাল পঞ্চায়েতের হরিনারায়ণপুর ও ব্যাংভুটা গ্রাম এবং বাঁশপাহাড়ির ওরোলি গ্রামে নতুন কমিটির সভা কোনও মতে বসলেও বাসিন্দাদের একাংশ সাফ জানিয়ে দেন, ‘আপনারা দয়া করে আর আসবেন না। আমাদের শান্তিতে থাকতে দিন।’ কোথাও কমিটির নেতৃত্বকে শুনতে হয়েছে, ‘তৃণমূল আমাদের ভাতে মারতে চাইছে বুঝলাম। কিন্তু তোমরা তো আমাদের অনেককে প্রাণে মেরে দিয়েছ।’

বেলপাহাড়ি পঞ্চ

তবে রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তার আশঙ্কা, “জঙ্গলমহলে মূলস্রোতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি সক্র্রিয় না হলে ভবিষ্যতে মাওবাদীদের এই ধরনের কমিটিকেই বিক্ষুব্ধ মানুষ সমর্থন করতে পারেন।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement