পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনের একাংশ শাসকদলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে এমন কিছু অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের হাতে এসেছে। আদতে পরিস্থিতি কী রকম, তা মালুম করতে এ বার সরাসরি রাজ্যের জেলায় জেলায় সফরে যেতে চলেছেন উপ-নির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুৎসি। কমিশন-সূত্রের ইঙ্গিত, এপ্রিলের গোড়াতেই নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলায় গিয়ে সেখানকার অবস্থা তিনি সরেজমিনে যাচাই করবেন। খতিয়ে দেখবেন প্রথম দফার ভোট-প্রস্তুতিও।
গত ২৫ মার্চ কলকাতায় জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের বৈঠকে জুৎসি জানিয়েছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি অভিযোগ করেছে যে, তারা এখনও নির্বাচন কমিশনের সক্রিয়তা ঠাহর করতে পারছে না। ভোট-বিজ্ঞপ্তি জারির কুড়ি দিন পরেও এমন অভিযোগ ওঠা মোটেই কাম্য নয় বলে জানিয়ে জুৎসি বৈঠকে দাবি করেন, রাজ্যের বেশ ক’জন ডিএম, এসপি এবং কয়েকটি থানার ওসি’র বিরুদ্ধে শাসকদলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে। কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগের প্রমাণও পৌঁছেছে কমিশনের হাতে।
এ হেন প্রেক্ষাপটে উপ-নির্বাচন কমিশনার সে দিন জানিয়ে গিয়েছিলেন, পরিস্থিতি সত্যিই এমন হয়ে থাকলে কড়া পদক্ষেপ করতে হবে। “এ রাজ্যেই বার বার প্রশাসনিক কর্তাদের নিরপেক্ষ থাকার কথা বলতে হচ্ছে।” মন্তব্য করেছিলেন তিনি। পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ মিললে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের সরিয়ে দেওয়ারও ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত কমিশনের প্রতিনিধি। নির্বাচন সদনের খবর: জুৎসি দিল্লি ফিরে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পতের কাছে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেছেন। এ-ও বলেছেন, এই রাজ্যে কমিশনের উপরে এখনও রাজনৈতিক দলগুলোর পূর্ণ আস্থা তৈরি হয়নি। উপরন্তু এখানে কিছু ক্ষেত্রে বিরোধীরা একযোগে রাজ্যের নির্বাচনী অফিসারের (সিইও) বিরুদ্ধে আঙুল তোলায় কমিশন বিস্মিত।
এর পরেই পক্ষপাতিত্বে অভিযুক্ত অফিসারদের ভোটের দায়িত্ব থেকে অবিলম্বে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে কমিশন-সূত্রের ইঙ্গিত। নির্বাচন সদনের এক কর্তা জানিয়েছেন, কিছু অফিসারকে বদলি করে নতুনদের হাতে দায়িত্ব অর্পণের প্রক্রিয়া খুব শিগগিরই সেরে ফেলা হবে। প্রসঙ্গত, উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের ৪৪ জন সিনিয়র অফিসারকে কমিশন ইতিমধ্যে সরিয়ে দিয়েছে, যাঁদের মধ্যে ২২ জন জেলাশাসক ও ১৯ জন পুলিশ সুপার। উপরন্তু বৃহস্পতিবার বিহারেও এক জেলাশাসক ও তিন পুলিশ সুপার-সহ ছয় অফিসারকে বদলি করা হয়েছে।
একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গ নিয়েও কমিশন সত্বর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পক্ষপাতী। “উপ-নির্বাচন কমিশনার এ বার সরাসরি রাজ্যের জেলায় জেলায় গিয়ে পরিস্থিতি দেখবেন। জেলাস্তরের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। স্পর্শকাতর বুথ বাছাই থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন, সবই তদারক করবেন উনি।” এ দিন বলেন কমিশনের এক কর্তা। তবে জুৎসি ঠিক কোন কোন জেলায় যাবেন, কমিশনের তরফে তা এখনও জানানো হয়নি। যদিও ২৫ তারিখের বৈঠকে জুৎসি মুর্শিদাবাদের জেলাশাসককে আগাম বার্তা দিয়েছেন যে, তিনি বহরমপুরে যাবেন। মনে করা হচ্ছে, প্রতি দফা ভোটের আগেই উপ-নির্বাচন কমিশনার এ রাজ্যে আসবেন। ১৭ এপ্রিল রাজ্যে প্রথম দফা ভোটের আগে তিনি উত্তরবঙ্গে যেতে পারেন। প্রশাসনের নিরপেক্ষতা যাচাই করতে পরে তিনি সফর করতে পারেন মধ্য ও দক্ষিণবঙ্গে।
রাজ্যের কোন কোন অফিসারের ‘কালো তালিকা’য় থাকার সম্ভাবনা?
কমিশন-সূত্রের ইঙ্গিত, বীরভূমের জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের কাজে উপ-নির্বাচন কমিশনার বিশেষ সন্তুষ্ট নন। বৈঠকে নদিয়ার এসপি’কেও তিনি কড়া কথা শুনিয়েছেন। মাওবাদী দমনে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের ভূমিকা প্রশংসা পেলেও করলেও সেখানকার এসপি সম্পর্কে কিছু ‘তথ্য’ কমিশনের হাতে পৌঁছেছে। একই ভাবে বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার সম্পর্কে বৈঠকে কিঞ্চিৎ উষ্মা প্রকাশ করে গিয়েছেন জুৎসি। বেশ কয়েকটি থানার ওসি’র বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। জুৎসির পরবর্তী রাজ্য সফরের আগেই ওঁদের কাউকে কাউকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে কমিশন-সূত্রের অনুমান।
পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে আসা নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের জন্য বিশেষ নির্দেশিকা পাঠিয়েছে কমিশন। তাতে বলা হয়েছে, আচমকা বুথ পরিদর্শনে নামতে হবে। রুটিন পাঁচটি রিপোর্টের বাইরে ভোটের পাঁচ দিন আগে প্রস্তুতির খবরাখবর জানিয়ে বিশেষ রিপোর্ট পাঠাতে হবে। ভোটের তিন দিন পরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে চাই আলাদা রিপোর্ট।
পশ্চিমবঙ্গের উপরে কমিশনের যে ‘বিশেষ’ নজর রয়েছে, এই নির্দেশিকা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলে মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের একাংশ।