মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যোগ দিতে পতাকা হাতে হাজির ছিটমহলের বাসিন্দারা। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই ছিটমহল বিনিময়ের বিপক্ষে কড়া অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। কোচবিহারের মাথাভাঙায় ২০১১ সালের এক সভায় বলেছিলেন, “এক ছটাক জমিও ছাড়ব না।” বৃহস্পতিবার সেই কোচবিহারেরই দিনহাটার সীমান্ত এলাকায় সরকারি সভা-মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন, ছিটমহল বিনিময়ে তিনি রাজি। এবং এ-ও দাবি করলেন, তিনি বরাবর ছিটমহল বিনিময়ের পক্ষেই ছিলেন।
অতীত অবশ্য অন্য কথা বলছে। একাধিক বার দেখা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার স্থলসীমা চুক্তি সংসদে পাশ করাতে গেলেই শোরগোল করে অধিবেশন ভেস্তে দিয়েছেন তৃণমূল সাংসদরা। কিন্তু এ দিন মমতা যখন বলেছেন যে, তিনি তাঁর ‘অফিশিয়াল’ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছেন, স্বভাবতই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন ছিটমহলের বাসিন্দারা। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, রাজ্যের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দ্রুত কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দেওয়া হবে। তবে ছিটমহল বিনিময়ের পরে এলাকার পরিকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্ব কেন্দ্রকেই নিতে হবে বলে জানান তিনি।
দিনহাটায় নয়ারহাটের ডাকুয়ারহাট এলাকায় এ দিনের ওই সভায় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের কথাও তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সম্প্রতি খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে জামাতুল মুজাহিদিন (জেএমবি)-র জঙ্গিরা পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি গেড়ে বাংলাদেশে নাশকতা ছড়াতে সক্রিয় বলে অভিযোগ উঠেছে। অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে তৃণমূলকেও। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “দুই বাংলার মধ্যে সব সময় মধুর সম্পর্ক ছিল, আছে, থাকবে। ছিটমহলের বাসিন্দাদের দুর্দশার কথা আমি জানি। স্বাধীনতার পর থেকে তাদের জুটছে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা। যারা বাংলাদেশের বাসিন্দা তারা বাংলাদেশে ফিরে যেতে চায়। যারা ভারতের, তারা ভারতে থাকতে চায়। দু’দেশের মধুর সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে এই কাজ সম্পন্ন হোক, এটা আমরা চাই। ছিটমহল বিনিময় আমরা চাই।” কেন্দ্রের কাছে পুনর্বাসন প্যাকেজ চাওয়া হবে বলে জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ছিটমহল বিনিময়ের পর থাকা, খাওয়া, স্কুল-কলেজ, রাস্তা, পরিকাঠামো তৈরির জন্য টাকার দরকার হবে। কেন্দ্রকে ওই দায়িত্ব নিতে হবে। ছিটের সঙ্গে কোচবিহারেরও অনেক উন্নয়ন হবে। আমরা এটা করবই। আমরা আমাদের অফিশিয়াল সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে গেলাম।”
দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে আন্দোলন চলছে। বাম সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন ফরওয়ার্ড ব্লক ছিটমহল বিনিময়ের দাবি তুলে একাধিক বার আন্দোলন কর্মসূচি নেয়। শুধু রাজনৈতিক দলের দাবিতে ওই সমস্যা মেটা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে, গড়ে ওঠে ‘ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহাল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’। প্রয়াত ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক দীপক সেনগুপ্ত, প্রয়াত সাংসদ অমর রায়প্রধান, প্রাক্তন বিধায়ক সোমেন দাস ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। বাম আমলে এই সমস্যার জট খোলেনি।
রাজ্যে পট পরিবর্তনের পর মমতাও ‘এক ছটাক জমি ছাড়ব না’ বলায় ছিটমহলের বাসিন্দাদের হতাশা বেড়ে যায়। সেই মন্তব্যের বিরোধিতাও শুরু হয় নানা মহলে। তবে গত লোকসভা ভোটের সময় থেকেই মুখ্যমন্ত্রী অবস্থান বদলাতে শুরু করেন। ছিটমহল সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার আশ্বাস দেন তিনি। তার পর থেকেই দুই দেশের ১৬২টি ছিটমহলের ৫১ হাজারের বেশি বাসিন্দারা আশার আলো দেখেন।
সম্প্রতি সংসদে ছিটমহল বিনিময় সংক্রান্ত স্থলসীমান্ত চুক্তি বিলটি পাশ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ওই বিলের খসড়া অনুমোদন করে সংসদে পেশের ছাড়পত্র দিয়েছে। কেন্দ্রের তরফেও বিলটি সংসদে আনার কথা ঘোষণা করা হয়। এই পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানের কৃতিত্ব নিতেই যে মুখ্যমন্ত্রী তড়িঘড়ি ছিটমহল লাগোয়া ওই সীমান্ত এলাকায় সরকারি সভা করলেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহার জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহ বলেন, “ফরওয়ার্ড ব্লকই একমাত্র রাজনৈতিক দল, যারা ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় এক সময় ছিটমহল বিনিময়ের কড়া বিরোধিতা করেছিলেন। এখন যখন সব রাজনৈতিক দল বিনিময়ের পক্ষে, সে সময় তিনি সভার নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করলেন। আসলে এটা প্রায়শ্চিত্তের সভা।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা তথা রাজ্যের পরিষদীয় সচিব রবীন্দ্রনাথ ঘোষের অবশ্য পাল্টা দাবি, “মুখ্যমন্ত্রীর আগে ওই সমস্যা মেটানোর কথা কেউই আন্তরিক ভাবে ভাবেননি। উদয়নবাবুরা ওই ছিটমহলে হার্মাদদের জমা করে ভোট করাতেন। সংসদেও ওদের কেউ কখনও সরব হননি।” রবিবাবুর দাবি, ছিটমহল বিনিময় সফল হলে তার কৃতিত্ব মুখ্যমন্ত্রীর।
বৃহস্পতিবার কোচবিহারে দিনহাটার নয়ারহাটে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে যান মুখ্যমন্ত্রী।
করলা ছিটমহল সংলগ্ন এলাকায় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথাও বলেন তিনি।—নিজস্ব চিত্র।
রাজনৈতিক দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যেও মুখ্যমন্ত্রীর ‘অফিশিয়াল’ ঘোষণায় আপ্লুত ছিটমহলের বাসিন্দারা। মশালডাঙার বেলাল হোসেন, আজগর আলি, সাদ্দাম হোসেনরা মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে চোখ মুছেছেন। ‘ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহাল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’র নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগ ও ঘোষণাকে সাধুবাদ জানাই। কেন্দ্রও কোমর বেঁধে নেমেছে। এত দিনে সমস্যা সমাধান নিয়ে আশার আলো দেখছি।” এ দিন সভার শুরুতে ছিটমহলের ১৬ জন বাসিন্দার হাতে চাদর তুলে ‘সংবর্ধনা’ দেন মুখ্যমন্ত্রী। ছিটমহলের বাসিন্দাদের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকেও শুভেচ্ছা পত্র তুলে দেওয়া হয়। দীপ্তিমানবাবুর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী ছিটমহলবাসীদের সংবর্ধিত করায় আমরা অভিভূত।”