আবার সে এসেছে ফিরিয়া!
পাগলা দাশু নয়। তবে হাঁসজারু বা বকচ্ছপ বলা যেতেই পারে। বাঙালি ছানার সন্দেশের অঙ্গে-অঙ্গে যখন বাঁশি বাজাচ্ছে চকোলেটের প্রলেপ। আবার ছানার পাকের তুকতাক মেখে কৃষ্ণকলি চকোলেট হয়ে উঠছে জগতের আলো। গত দু’বছর ধরেই কলকাতা তথা এ রাজ্যের মিষ্টিপ্রেমীদের জন্য বচ্ছরকার পার্বণ হয়ে উঠেছে ‘ক্যাডবেরি-মিষ্টি, সেরা সৃষ্টি’ প্রতিযোগিতা। আনন্দবাজার সংস্থার উদ্যোগে এই মিষ্টি-যুদ্ধ সাবেক ময়রাদের মধ্যেও উস্কে দিচ্ছে নতুন সৃষ্টির তাগিদ।
তবে এই নিরীক্ষার শিকড় নেহাতই একেলে বলে মানতে রাজি নন বিশেষজ্ঞেরা। বিজাতীয় উপকরণ কিংবা ভিন্ধর্মী রন্ধনশৈলীর মিশেলে এমন মিলিজুলি ঘরানার নাম ফিউশন। আর ফিউশন তো বাঙালি মিষ্টির রক্তে! অনেকেরই জানা, ব্যান্ডেলে জার্মান ও ওলন্দাজ পাদ্রীদের পট-চিজ তৈরির কৌশল আপন করেই ছানার ম্যাজিকে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে বাঙালি ময়রা। বাঙালি মিষ্টিরও দিক খুলে যায়!
সাবেক বাঙালি রান্নার চর্চায় পোড়খাওয়া রাখিপূর্ণিমা দাশগুপ্ত মনে করাচ্ছেন পটলের দোলমার কথা! আর্মেনিয়া, গ্রিসের দোলমাকে আপন করে নিয়েই বাঙালি মাথা খাটিয়ে পটলের পেটের ভেতর মাছ, মাংস কি ছানার পুর ভরে নিয়েছে। কারও কারও মত, নারকোলের দুধবিশিষ্ট চিংড়ির মালাইকারি আদতে ‘মালয় কারি’। অর্থাৎ, দক্ষিণ-পুব এশিয়া তথা মালয়দেশ থেকে এই তল্লাটে এসেই তা বঙ্গজীবনে মিশে গিয়েছে। আবার উল্টো দিক থেকে দেখলে প্রাচ্যের ‘কারি’ বা ঝোল-ঝোল রান্নাকে ‘ন্যাশনাল ডিশ’-এর মর্যাদায় আপন করে নিয়েছে ব্রিটেন। সে দেশে কারি-সপ্তাহ পর্যন্ত পালন হয়!
এ যুগে ফিউশনের প্রভাব আগের থেকেও বেড়েছে। উপনিবেশ আমলের চেয়েও দ্রুতগতিতে ইন্টারনেটের দৌলতে বিভিন্ন সংস্কৃতি কাছাকাছি আসছে। সঙ্গীত, পোশাক থেকে ভোজ-রীতি সব কিছুতেই বাড়ছে ফিউশনের প্রভাব।
বাস্তবিক, আজকের চিকেন টিক্কা স্যান্ডউইচ বা কিমা দোপিঁয়াজা পিৎজা থেকে শুরু করে নামী রেস্তোরাঁয় জাপানি ময়দা বা ‘টেম্পুরা’র ব্যাটারের পকোড়ায় অবধি ফিউশনেরই রকমফের।
সকলেই যে এই ফিউশন পছন্দ করছেন, তা বলা যায় না। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়ের যেমন আশঙ্কা, ফিউশনের ফলে কোথাও কোথাও সংস্কৃতির বৈচিত্র ক্ষুণ্ণ হয়। সর্বত্র মানুষ এক ধরনের খাবার বা পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তবু ফিউশন যে নানা ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতার দরজা খুলে দিয়েছে, সেটাও অস্বীকার করা যায় না।
অর্ধশতাব্দীরও আগে উত্তর কলকাতায় চকোলেট সন্দেশের পথ চলা শুরু। নতুনবাজারের মাখন-নলিনের দোকানের চকোলেট সন্দেশ তখন থেকেই জনপ্রিয়। আজকের ক্যাডবেরি-মিষ্টি সেই ধারাকেই আরও সমৃদ্ধ করেছে। আর ক্যাডবেরি-মিষ্টি নিয়ে এমন নিরীক্ষার যুগে দেখা যাচ্ছে, কলকাতার কাছেই রিষড়ার মন্দিরে গণেশপুজোর বাঁধা প্রসাদ, চুড়ো-আকৃতি মোদকে অবধি পড়েছে চকোলেটের প্রলেপ। প্রসাদ হিসেবে চলছে চকোলেটের গুঁজিয়াও।
কলকাতা, হুগলি, বারাসত, বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, বর্ধমান, দুর্গাপুর, আসানসোলকে নিয়ে শ’খানেক মিষ্টির দোকান এখন নতুন ‘ক্যাডবেরি-মিষ্টি’ তৈরির প্রতিযোগিতায় সামিল। জলভরার সূর্য মোদক, গজা-লবঙ্গলতিকার ফেলু ময়রা, সরপুরিয়ার অধরচন্দ্র দাস, ছানাবড়ার আনন্দ সুইট্স থেকে বেক্ড রসগোল্লার বলরাম--- সামিল এই সৃষ্টির টক্করে। ফুটবল বিশ্বকাপের বছরে আবার বাঙালির ফুটবল ও মিষ্টি আবেগ--- দু’টোই মিশে যাচ্ছে। ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা, জার্মানি, ইংল্যান্ডের মতো ফুটবলে তুখোড় আটটি দেশের নামে আট ধরনের নতুন মিষ্টি তৈরি করবে সকলে।
মিষ্টির অবতারে বকচ্ছপ-হাঁসজারুদেরই তাই এখন জয়জয়কার।