রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের পারস্পরিক ঝগড়া দেখে গত সপ্তাহে দলীয় বৈঠকে বিরক্ত হয়েছিলেন রাহুল গাঁধী। অথচ বুঝে হোক বা না বুঝে সেই রেষারেষিতে আজ তিনিই ঘি ঢেলে দিলেন! প্রাক্তন তিন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য, মানস ভুঁইয়া ও সোমেন মিত্র এবং বর্তমান সভাপতি অধীর চৌধুরী-সহ রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের আজ দ্বিতীয় দফার বৈঠকে ডেকেছিলেন রাহুল। সেই বৈঠকে তিনি দুম করে বলে বসেন, আপনাদের কথা শুনে বুঝতে পারছি, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে বিশ্বাস করেন মাত্র দু’জন! অধীর চৌধুরী ও মানস ভুঁইয়া! বাকিদের মধ্যে সেই বিশ্বাসটাই দেখছি না!
বৈঠকে উপস্থিত প্রদেশ নেতারা বলছেন, খানিকটা হাল্কা চালেই কথাটা বলেছেন রাহুল। প্রদেশ নেতারা যাতে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করেন, তার জন্য রাহুল রাজ্য স্তরে ১২ সদস্যের একটি কোর কমিটিও গড়ে দিয়েছেন। যার উদ্দেশ্য, অধীরের সঙ্গে প্রদেশ নেতৃত্বের একাংশের টানাপড়েনে ইতি টেনে সমন্বয় ঘটানো। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও তাঁর ওই একটি মন্তব্যই আজ ফের নাড়িয়ে দিয়েছে রাজ্য কংগ্রেসের কিছু নেতাকে। দলের এক নেতার মন্তব্য, “এ তো আত্মশ্লাঘায় ঘা দেওয়ার মতোই কথা!”
রাহুলের মন্তব্য ছাড়াও বাংলার কংগ্রেসকে নিয়ে তাঁর আগ্রহ দেখেও প্রদেশ নেতাদের অনেকে বিস্মিত। দলের এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, “গত সপ্তাহে প্রতি মাসে রাজ্য নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য দলের সহ-সভাপতির কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রদীপদা। রাহুল আজ নিজেই বলেছেন, প্রতি মাসে আমাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে তিনি আগ্রহী।” রাহুলের মনোভাবে প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে যুগপৎ কৌতূহল এবং কিছুটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। প্রদেশ নেতাদের কেউ ভাবছেন, দলকে ঐক্যবদ্ধ করাই রাহুলের মূল উদ্দেশ্য। কারও মনে হয়েছে, ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে রাহুলের মন্তব্য আসলে তৃণমূলের সঙ্গে জোটের ইঙ্গিত। বৈঠকে রাহুলই পরামর্শ দিয়েছেন, শুধুই সারদা-কাণ্ড নিয়ে আন্দোলন করলে বিজেপি লাভবান হতে পারে। ভবিষ্যতের পথ বুঝে নিতে চেয়েই দীপা দাশমুন্সি বৈঠকে তুলেছিলেন, ইউপিএ-১ আমলে বামেদের সঙ্গে সমঝোতা, ইউপিএ-২ আমলে তৃণমূলের সঙ্গে জোট এবং ২০১১-য় রাজ্যে পরিবর্তনের সময় আত্মসমর্পণ, আবার ২০১৪-র লোকসভায় একলা লড়াই এত রকম রাস্তা বদলে কংগ্রেস কর্মীরা দিশাহারা! দলের কর্মীদের আগে বোঝাতে হবে, কেন তাঁরা কংগ্রেস করবেন!
ভবিষ্যতের পথ নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যেই রাহুলের আজকের মন্তব্য আরও ধন্দ বাড়িয়েছে প্রদেশ কংগ্রেসের অন্দরে! দলে এই মুহূর্তে অধীরের ঘোর বিরোধী আব্দুল মান্নান। চোখের চিকিৎসার জন্য মান্নান আজ রাহুলের ডাকা বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে দলের সহ-সভাপতির মন্তব্য শুনে তাঁর বক্তব্য, “দল ঘুরে দাঁড়ালে সব চেয়ে খুশি হব আমিই!” কিন্তু রাহুলের কথায় তাঁর কি আঁতে ঘা লাগছে না? মান্নানের জবাব, “এ জন্মে কংগ্রেস তো ছাড়তে পারব না। সত্যি কথা বলে যাব। তাতে দল যা সিদ্ধান্ত নেয়, নেবে!” মজার কথা, ১২ জনের কোর কমিটিতে মান্নানকেও রেখেছেন রাহুল। যে কমিটির প্রথম বৈঠক ডাকা হয়েছে ৩ জানুয়ারি। কিন্তু মান্নান আজই জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর আয়োজিত ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল রয়েছে বলে ওই দিন বৈঠকে যেতে পারবেন না!
প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি প্রদীপবাবু অবশ্য মনে করেন, “রাহুল ওটা কথার কথা বলেছেন। বৈঠকে ১১ জন উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা কংগ্রেসের পুনরুজ্জীবন যদি না চাইবেন, তা হলে সেখানে গিয়েছিলেন কেন?” রাহুলের কাছে পেশ করা প্রদীপবাবুর ‘ভিশন ডকুমেন্টে’ও দলের পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যেই ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ দেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, সরাসরি রাহুলের মন্তব্যের বিরোধিতা না করলেও বৈঠকে সোমেনবাবু বলেন, কংগ্রেসের সম্ভাবনা রয়েছে বলেই তো তিনি দলে ফিরে এসেছেন! এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মানসবাবু অবশ্য হেসে বলেছেন, “মোদ্দা কথা হল, রাহুল কাজ ভাগ করে দিয়ে প্রত্যেককে নিজ দায়িত্ব পালন করতে বলেছেন।” আর অধীরের বক্তব্য, “সংগঠনকে শক্তিশালী করাকে পাখির চোখের মতো দেখতে বলেছেন রাহুল। দলের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে নবগঠিত কমিটির বৈঠকে কথা হবে।”
অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং অদূর ভবিষ্যতে ফের তৃণমূলের সঙ্গে জোটের জল্পনা নিয়ে যাবতীয় বিভ্রান্তির কারণেই সম্ভবত আন্দোলনের প্রশ্নে একটু ঝিমিয়ে রয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস। এই অবস্থায় সারদা-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দাবির পাশাপাশি বিদ্যুৎ মাসুল বৃদ্ধির প্রতিবাদে লাগাতার আন্দোলনে নামছে দলের যুব সংগঠন। বিধান ভবন থেকে সোমবারই মিছিল করে মৌলালি মোড়ে পথ অবরোধ করেছিল তারা। এ বার রাজ্যের প্রতিটি লোকসভা এলাকাতেই তাঁরা প্রতিবাদে নামছেন বলে জানিয়েছেন রাজ্য যুব কংগ্রেস সভাপতি অরিন্দম ভট্টাচার্য। জেলার কর্মসূচির পরে আগামী ৫ জানুয়ারি কলকাতার রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে দিনভর ধর্নায় বসবে যুব কংগ্রেস।