শুক্রবার যাত্রা উৎসবে মুখ্যমন্ত্রী। সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।
কেন্দ্রীয় সরকারের পাঠানো কোটি কোটি টাকা পড়ে আছে, মানুষের কাজে তা খরচ করা হচ্ছে না। ১৮ জেলার হিসেব-নিকেশ দেখে কিছু জেলার উপরে বেজায় চটে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শহরে নানা কারণে ক্ষোভ বাড়ছে সরকারের বিরুদ্ধে। গ্রামেও যাতে সমর্থনে ধস না নামে, বছরের শুরু থেকেই সে দিকে মন দিতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। জোর দিতে চাইছেন সরকারি পরিষেবা ঠিকঠাক পৌঁছে দেওয়ার উপরে। এবং সে কারণেই শুক্রবার তিনি নবান্নে ১৮টি জেলার সভাধিপতি ও জেলাশাসকদের নিয়ে পর্যালোচনায় বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। লক্ষ্যণীয় ভাবে, বিরোধী দলের জেলা সভাপতিদেরও ডাকা হয়েছিল এই বৈঠকে। পুরভোটে বিজেপির বিরুদ্ধে বাকি বিরোধীদের এককাট্টা করতেই তৃণমূল নেত্রী এই কৌশল নিয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকে। কংগ্রেস পরিচালিত মুর্শিদাবাদ ও মালদহের সভাধিপতি বৈঠকে এলেও বাম পরিচালিত জলপাইগুড়ির নুরজাহান বেগম অনুপস্থিত ছিলেন।
কেন্দ্রীয় অনুদানের টাকা খরচের নিরিখে এগিয়ে থাকা জেলা তারিফ পেলেও তৃণমূল-শাসিত বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা পরিষদের কাজকর্ম নিয়ে এ দিন রীতিমতো ধমক দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সাফ কথা, দু’মাস সময় দেওয়া হল। কাজ হলে ভাল। নয়তো সরিয়ে দেওয়া হবে সভাধিপতিদের! উত্তর দিনাজপুর, কোচবিহারের মতো আরও যে দুয়েকটি জেলা পরিষদের কাজে মুখ্যমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, সেগুলির কর্তৃত্বও তৃণমূলের হাতে।
মুখ্যমন্ত্রীর ক্রুদ্ধ মনোভাব দেখে বৈঠকে উপস্থিত পঞ্চায়েত কর্তা এবং অন্য সরকারি আধিকারিকরা কিছুটা ঘাবড়েই গিয়েছেন। সরকারি সূত্রের খবর, বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, জেলা পরিষদগুলিতে এখনও প্রায় ৬০০ কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। একেই টাকা পাওয়া যায় না। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তা-ও খরচ করতে পারছে না কিছু জেলা পরিষদ। এ ভাবে চলতে পারে না! মার্চের মধ্যে সব টাকা খরচ করে ফেলতে হবে।
শাসক দলের অন্দরের খবর, সামনে পুরভোট। তাতে বিজেপির মোকাবিলায় মমতা যেমন এক দিকে দলকে তৈরি থাকতে বলছেন, তেমনই হাতে সময় থাকতেই গ্রামে নজর দিচ্ছেন। অতীতে বামফ্রন্ট সরকার বহু বার নির্বাচনী বৈতরণী পেরিয়েছে গ্রামের ভোটব্যাঙ্কের ভরসায়। আগামী বছর বিধানসভা ভোট। শহর বিমুখ হলেও গ্রামের ফসলই যাতে ওই পরীক্ষায় উতরে দেয় তার জন্যই জেলার কাজকর্ম নিয়ে এ ভাবে মাথা ঘামাচ্ছেন মমতা। এমনকী ক্ষমতায় এসে ইস্তক যা করেননি, করেছেন সেটাও। নবান্ন সূত্রের খবর, মাসখানেক আগে মুখ্যসচিব জেলা পরিষদগুলির কাজকর্ম নিয়ে পর্যালোচনা শুরুর পরামর্শ দিলে মুখ্যমন্ত্রী নিজের দল এবং বিরোধী জেলা পরিষদগুলিকেও বৈঠকে ডাকার কথা বলেন। সেই সূত্রেই কংগ্রেস পরিচালিত মুর্শিদাবাদ ও মালদহের সভাধিপতি শিলাদিত্য হালদার ও সরলা মুর্মু হাজির ছিলেন এ দিনের বৈঠকে। তবে মাসদেড়েক আগেই দলের কর্মী সম্মেলনে যে কয়েকটি জেলা পরিষদের নেতৃত্বকে মমতা রাজনৈতিক ভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, এ দিন তিরস্কার জুটেছে বেশি তাঁদেরই।
গত সপ্তাহেও জেলা সফরে গিয়ে যে মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক বৈঠকে বিরোধী দলের বিধায়ক-সহ কোনও জনপ্রতিনিধিকেই ডাকেননি, তিনিই এ দিন কেন বিরোধীদের ডাকলেন, তা নিয়ে নানা জল্পনা শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, আসলে বিজেপির বাড়বাড়ন্তে মুখ্যমন্ত্রী উদ্বিগ্ন। তাই তাঁর কাছে সিপিএম-কংগ্রেস যে এখন আর ‘অচ্ছুত’ নয়, সেই বার্তা দিতেই তিনি উন্নয়ন বৈঠকের নামে সকলকে ডেকেছেন। প্রশাসনিক বৈঠকের নামে তিনি আসলে ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপির বিরুদ্ধে বাকি সব দলকে এক করার কৌশল নিয়েছেন। তবে তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “বিজেপির হাতে তো এখন কোনও জেলা পরিষদ নেই! থাকলে তাদের বাদ দিয়ে যদি অন্যদের ডাকা হতো, তা হলে এমন বার্তা দেওয়ার কথা উঠত! মুখ্যমন্ত্রীর নিশ্চয়ই মনে হয়েছে, গ্রামে পরিষেবা নিয়ে পর্যালোচনা করতে গেলে সব জেলা পরিষদকেই ডাকা দরকার।”
মমতা নিজেও টুইট করেছেন, ‘মানুষের উন্নয়নে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। তার জন্য সকলের সহযোগিতা চাই’। যাঁদের ভাবনা ‘ইতিবাচক’, তাঁদের উপরে ভরসা রাখার বার্তাও দিয়েছেন তিনি। তবে নবান্নের বৈঠকের পরে জেলায় জেলায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকে কী হয়, সেই দিকে নজর রাখার কথা বলছে শাসক দলের একাংশও।
দুর্গাপুরে তৃণমূলের কর্মী সম্মেলনে এর আগে মমতা জানিয়েছিলেন, উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির জন্য দু’টি পঞ্চায়েত সম্মেলন করতে চান। নবান্নের বৈঠকে এ দিন তিনি জানান, আগামী ১১-১২ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় সমস্ত নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যকে নিয়ে পঞ্চায়েত সম্মেলন হবে। তাতেও বিরোধী দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ডাকা হবে। ৫-৬ ফেব্রুয়ারি জেলা স্তরের পঞ্চায়েত সম্মেলনেও রাজ্যের তরফে বিরোধী পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত এবং জেলা পরিষদগুলিকে সাহায্য করা হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম প্রশাসনিক বৈঠক কেমন হল?
মুর্শিদাবাদের সভাধিপতি শিলাদিত্যবাবু বলেন, “এটা আগেই হওয়া উচিত ছিল! মন্দের ভাল যে, তিনি শেষ পর্যন্ত আমাদের ডেকেছেন। বহরমপুরের রেলওয়ে ওভারব্রিজ ও একটি জলপ্রকল্পের কথা বলেছি। কোনও সরকারি অনুষ্ঠানে যে সভাধিপতিকে ডাকা হয় না, সেই প্রসঙ্গও তুলেছিলাম।” শিলাদিত্যবাবু জানান, এখন থেকে বিরোধী দলের সভাধিপতিদের সব সরকারি অনুষ্ঠানে ডাকার জন্য মুখ্যসচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকে মালদহের সভাধিপতি সরলা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছেন, তাঁকে তো কোনও ফাইলই দেওয়া হয় না! কোথাও ডাকাও হয় না। আর সিপিএম-শাসিত জলপাইগুড়ির সভাধিপতি নুরজাহান বৈঠকে না আসার কারণ জানিয়ে বলেন, “আমি অসুস্থ। দল আমাকে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে যেতে নিষেধ করেনি। কিন্তু শরীর খারাপ বলেই যেতে পারিনি।”
বৈঠকে এ দিন যে সব কেন্দ্রীয় বা রাজ্যের প্রকল্প সরাসরি জেলা পরিষদ মারফত খরচ হয়, তার পর্যালোচনা করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, “জেলা পরিষদগুলি বছরে গড়ে ১৫০০ কোটি টাকা পেয়ে থাকে। তার ৩০% টাকাই সময়ে খরচ হয় না। ফলে কেন্দ্র থেকে প্রাপ্য পুরো টাকাটা রাজ্য পায় না। সেই কারণেই (গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত) ১৯টি জেলা পরিষদে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা পড়ে আছে। মুখ্যমন্ত্রী চান এই টাকা যেন মার্চের মধ্যে খরচ হয়।”
বাঁকুড়া জেলা প্রায় ২৮% টাকা এখনও খরচ করতে পারেনি। বাঁকুড়ার সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীকে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, স্যুট পরে সাহেব হয়ে ঘুরে বেড়ালেই হবে না। কাজ কোথায়? দু’মাসে উন্নতি না হলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন মমতা। পশ্চিম মেদিনীপুরের সভাধিপতি উত্তরা সিংহ এবং পুরুলিয়ার সৃষ্টিধর মাহাতোকেও টাকা খরচ না হওয়ায় ধমক দেন মুখ্যমন্ত্রী। উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনশলের কাছেও মমতা জানতে চান, কেন সময়ে কাজ শেষ হচ্ছে না। পরে বাঁকুড়ার সভাধিপতি অরূপবাবুও মেনে নেন, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, জনগণের ভোট নিয়েছি, কাজ করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু কাজে আমাদের জেলার ভূমিকায় তিনি অসন্তুষ্ট। নিকাশির কাজে ও মুকুটমণিপুরের একটি প্রকল্প চালু করতে না পারায় তিনি অখুশি। এক মাসের মধ্যেই ওই সব কাজে গতি আনা হবে।”
পশ্চিম মেদিনীপুরের উত্তরাদেবী অবশ্য বলেন, “পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাকে বরাবর মুখ্যমন্ত্রী বেশি গুরুত্ব দেন। তাই উন্নয়নের কাজ আরও দ্রুত করতে বলেছেন তিনি।”