পুলিশের ঘেরাটোপে কমিশনের অফিসের পথে সুদীপ্ত সেন। ইডি-র অফিস থেকে বেরিয়ে আসছেন পিয়ালি সেন ও শুভজিৎ সেন। সুদীপ্ত ভৌমিক এবং শৌভিক দের তোলা ছবি।
লগ্নিকারীদের থেকে সংগৃহীত সারদার বিপুল অর্থের একাংশ কোথায় গেল, সুপ্রিম কোর্ট তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট (ইডি)-এর সন্দেহ, এর অনেকটা সুদীপ্ত সেন বিদেশে পাচার করে থাকতে পারেন। এবং সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতেই সুদীপ্তের প্রথম পক্ষের পুত্র শুভজিৎ সেন ও দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পিয়ালি সেন-কে বুধবার রাতে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইডি। বৃহস্পতিবার কোর্টে পেশ করা হলে ধৃতদের পাঁচ দিন ইডি-হেফাজতের নির্দেশ হয়েছে। এ দিন রাতে পিয়ালিকে নিয়ে ইডি অফিসাররা হানা দিয়েছিলেন সল্টলেকের একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে। জানা গিয়েছে, ওই ব্যাঙ্কে লকার ছিল পিয়ালির।
গ্রেফতার হওয়ার পরে সারদার অন্যতম ডিরেক্টর তথা সুদীপ্তের একদা ছায়াসঙ্গিনী দেবযানী মুখোপাধ্যায়ও কমিশনের সামনে অভিযোগ করেছিলেন যে, সুদীপ্ত সারদার বিস্তর টাকা পিয়ালিকে দিয়েছেন। ইডি’রও আশা, বিদেশে টাকা পাঠানোর বিষয়ে পিয়ালি ও শুভজিৎ— দু’জনের কাছ থেকে গুরুত্বর্পূণ তথ্য মিলতে পারে। বস্তুত পিয়ালি ও শুভজিৎ গত ক’মাসে ফোনে কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তদন্তকারীদের চারটি দল তার উপরে নজরদারি চালিয়েছিল। ইডি-র দাবি, ওঁদের ফোনের কল-লিস্টে বেশ ক’জন ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তির নাম মিলেছে।
পিয়ালি ও শুভজিৎকে বুধবার সারা রাত ও বৃহস্পতিবার সকালে দফায় দফায় সল্টলেকের ইডি অফিসে জেরা করা হয়। এ দিন দপুরে দু’জনকে তোলা হয় কলকাতার নগর দায়রা আদালতে। ইডি-র কৌঁসুলি অভিজিৎ ভদ্র ও ভাস্করপ্রসাদ বন্দ্যোপাধায় জানান, শুভজিৎ তাঁর একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে আড়াই কোটি টাকা সরিয়েছেন, যেখানে ১১ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকা পড়ে রয়েছে। পিয়ালির এক অ্যাকাউন্ট থেকে দু’কোটি সরানো হয়েছে। ওই অ্যাকাউন্টে এখন রয়েছে ৩ লক্ষ ২৭ হাজার টাকা। এর থেকেই বিদেশে টাকা পাচার সম্পর্কে ইডি’র সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। কিন্তু ধৃতেরা জেরায় কী বলেছেন?
ইডি-সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে দু’জনেরই দাবি: আমজনতাকে প্রতারণার ফলাও কারবার সম্পর্কে তাঁরা আদৌ অবহিত ছিলেন না। ওঁদের বক্তব্য, খাতায়-কলমে সংস্থার ডিরেক্টর হওয়ার সুবাদে মাঝে-মধ্যে তাঁদের চেক সই করতে হতো, তার বেশি কিছু নয়। যদিও তদন্তকারীদের অভিযোগ, পিয়ালি ও শুভজিৎ আমানতকারীদের টাকায় নামে-বেনামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কিনেছেন। আমানতকারীদের কয়েক কোটি টাকা সরানো ছাড়াও কিছু বিনিয়োগও করেছেন, ‘প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং’ আইনের ৩ নম্বর ধারা মোতাবেক যা সম্পূর্ণ বেআইনি। পিয়ালি-শুভজিতের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার ছাড়াও বেশ ক’টি ফ্ল্যাটের মালিকানার হদিসও মিলেছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।
ধৃতদের কৌঁসুলিরা এ দিন দাবি করেন, পিয়ালি-শুভজিতের নামে ইডি মিথ্যে মামলা করেছে। বিবাদী পক্ষের যুক্তি, দু’জনকে ধরা হয়েছে যে মামলায়, তার মূল অভিযুক্ত সুদীপ্ত ও দেবযানী ইতিমধ্যে জামিন পেয়েছেন। তা ছাড়া সারদা-কাণ্ডের তদন্ত করছে রাজ্য সরকারের বিশেষ তদন্তকারী দল, উপরন্তু সিবিআই ডাকার আর্জি সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাধীন।
দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে বিচারক মহম্মদ মুমতাজ খান ধৃতদের পাঁচ দিন ইডি-র হেফাজতে রাখতে বলেন। সুদীপ্ত সেনের এই ছেলে এত দিন কী করছিলেন? “শুভজিৎ নিজে কোনও কাজ করতেন না। দামি বিদেশি গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। আর দরকার পড়লে সারদা-র অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিতেন।”— বলেন এক তদন্তকারী অফিসার। গোয়েন্দা-সূত্রের খবর, সুদীপ্তের গ্রেফতারির পরে তিনটি বিদেশি গাড়ি বেচে দিয়ে মোটা টাকা নিয়ে কলকাতা ছাড়েন শুভজিৎ। কিছু দিন পরে সেই টাকা ফুরিয়ে যায়। ইতিমধ্যে পুলিশ ও ইডি এক-এক করে সারদার প্রতিটি অ্যাকাউন্ট সিল করে দেওয়ায় টাকার জোগান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। টাকা জোগাড় করতেই তিনি সম্প্রতি বেহালার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এসেছিলেন।
একই ভাবে পিয়ালিও প্রয়োজনে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে খরচ মেটাতেন। এবং অ্যকাউন্ট সিল হওয়ায় তিনি-ই বেশি সমস্যায় পড়েন। ইডি-সূত্রের খবর, বুধবার রাতে ইডি-র সল্টলেকের অফিসে জেরার মুখে কার্যত কাঁদতে কাঁদতে পিয়ালি জানিয়েছেন, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে তাঁকে এখন সংসার চালাতে হচ্ছে। সল্টলেক ছেড়ে উঠে যেতে হয়েছে বাগুইআটিতে, বাপের বাড়িতে। ছেলে-মেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। এমনকী, টাকার অভাবে বাচ্চাদের অন্য স্কুলেও ভর্তি করাতে পারেননি বলে গোয়েন্দাদের কাছে আক্ষেপ করেছেন পিয়ালি।
সারদা-কর্মীদের প্রাপ্য অর্থ জমা না-করার অভিযোগে প্রভিডেন্ট ফান্ড দফতর যে মামলা দায়ের করেছিল, তাতে সুদীপ্ত ছাড়াও অভিযুক্ত-তালিকায় ছিলেন পিয়ালি ও শুভজিৎ। চার্জশিটেও ওঁদের নাম ছিল। কিন্তু পরে অতিরিক্ত চার্জশিট পেশ করে দু’জনের নাম বাদ দেওয়া হয়। কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যের পুলিশই বা কেন শুভজিৎ-পিয়ালিকে সারদা-তদন্তের আওতার বাইরে রাখল? যে প্রসঙ্গে আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য, সুদীপ্ত সেন সিবিআইকে দেওয়া চিঠিতে সারদার ভরাডুবির জন্য একাধিক ব্যক্তিকে দায়ী করে জানিয়েছিলেন, গ্রেফতার হলে তিনি এ বিষয়ে মুখ খুলবেন। অথচ তিনি মুখ খোলেননি। “হতে পারে, পরিবারকে তদন্তের আওতা থেকে বাদ দেওয়ার শর্তেই তিনি পুলিশকে সহযোগিতা করেছেন! সে জন্যই কি শুভজিৎ ও পিয়ালিকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি?”— প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী মহলের এক সূত্র। পুলিশের কী ব্যাখ্যা?
সল্টলেক কমিশনারেটের কর্তাদের যুক্তি, সারদার দৈনন্দিন কারবারে শুভজিৎ-পিয়ালির কার্যকরী ভূমিকা ছিল না বলেই তাঁদের তদন্তের আওতায় রাখা হয়নি। বস্তুত ইডি-র এই গ্রেফতারিকে অন্ধকারে পথ হাতড়ানো হিসেবে দেখছেন সল্টলেকের গোয়েন্দা-প্রধান অর্ণব ঘোষ। তাঁর কথায়, “পিয়ালি বা শুভজিৎ সারদার বিভিন্ন কোম্পানিতে স্রেফ কাগুজে ডিরেক্টর ছিলেন। যে ভাবে সুদীপ্ত সেনের রাঁধুনিকেও বিভিন্ন কোম্পানির ডিরেক্টর করে রাখা হয়েছিল। সংস্থার রোজকার কাজকর্মের সঙ্গে ওঁদের কোনও যোগ ছিল না। তাই সুদীপ্তর স্ত্রী-পুত্রকে বেশ ক’বার জেরা করা হলেও গ্রেফতার করার প্রয়োজন হয়নি।” ইডি-র তদন্তকারীরা অবশ্য পুলিশের এ হেন যুক্তি মানতে রাজি হননি। তাঁদের দাবি, সারদার টাকা শেষমেশ কোথায় গিয়েছে, তা খুঁজে বার করতে শুভজিৎ-পিয়ালির দেওয়া তথ্য প্রাসঙ্গিক হতে পারে। এ পর্যন্ত যা হিসেব, তাতে সারদা সব মিলিয়ে বাজার থেকে ২৪০০ কোটি টাকা তুলেছিল। এর প্রায় তিনশো কোটি বিভিন্ন মিডিয়া সংস্থা চালাতে খরচ হয়েছে। আমানতকারীদের মেটানো হয়েছিল প্রায় হাজার কোটি। সংস্থা চালাতে মোটা টাকা বেরিয়েছে। কিন্তু এ সবের পরেও কয়েকশো কোটি টাকার হিসেব মিলছে না।
ওই বেপাত্তা অর্থের হদিস পাওয়ার কোনও সূত্র পিয়ালি-শুভজিতের কাছে রয়েছে কি না, ইডি আপাতত তা-ই জানার চেষ্টা চালাচ্ছে।
(প্রতিবেদন: সুনন্দ ঘোষ, জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়, শমীক ঘোষ ও কাজল গুপ্ত)