ইডি আসছে শুনেই লকার খুলল পুলিশ

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী পিয়ালি সেনের একটি লকার নিয়ে পুলিশ এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়েছে। বছরখানেক ধরে সারদা মামলা চলা সত্ত্বেও বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ এত দিন সল্টলেকের বি-ডি ব্লকে ওই ব্যাঙ্কের লকারটি খোলার ব্যবস্থা করেনি। অথচ ইডি লকারটি বাজেয়াপ্ত করতে চলেছে জানা মাত্রই তড়িঘড়ি আদালতের অনুমতি নিয়ে মঙ্গলবার রাতে লকারটি খোলে তারা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৩
Share:

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী পিয়ালি সেনের একটি লকার নিয়ে পুলিশ এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়েছে।

Advertisement

বছরখানেক ধরে সারদা মামলা চলা সত্ত্বেও বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ এত দিন সল্টলেকের বি-ডি ব্লকে ওই ব্যাঙ্কের লকারটি খোলার ব্যবস্থা করেনি। অথচ ইডি লকারটি বাজেয়াপ্ত করতে চলেছে জানা মাত্রই তড়িঘড়ি আদালতের অনুমতি নিয়ে মঙ্গলবার রাতে লকারটি খোলে তারা। তার আগে অবশ্য ইডি-কে চিঠি লিখে সল্টলেক গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়ে দেয়, তারা লকারটি খুলতে চলেছে। পুলিশি সূত্রের খবর, লকারে গয়নাগাঁটি ছাড়া আর বিশেষ কিছু মেলেনি। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আজ, বুধবার সেগুলো বিচারকের সামনে পেশ করা হবে।

প্রশ্ন উঠেছে, সারদা-প্রধান প্রায় এক বছর আগে ধরা পড়া সত্ত্বেও পুলিশ এত দিন তাঁর স্ত্রীর ওই লকার কেন খোলেনি? ইডি সেটি বাজেয়াপ্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে জেনে রাতারাতি সেটি খোলাই বা হল কেন? পিয়ালির গ্রেফতারি নিয়েও ঠিক একই ধরনের প্রশ্ন উঠেছিল। পিয়ালি প্রথমে সল্টলেকে থাকতেন। সারদার আর্থিক কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার পরে সেই বাড়ি সিল করে দেওয়ায় তিনি উঠে যান বাগুইআটির একটি ফ্ল্যাটে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেনি। শেষ পর্যন্ত ইডি গত ১৬ এপ্রিল তাঁকে গ্রেফতার করে। পিয়ালি ওখানে থাকেন জেনেও পুলিশ তাঁকে কেন গ্রেফতার করছিল না, সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি।

Advertisement

বছরভর উদাসীন থেকে পুলিশ হঠাৎ পিয়ালির লকারটি খুলল কেন, জবাব মিলছে না সেই প্রশ্নেরও। ইডি-কর্তারা এই বিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি। ইডি সূত্রের দাবি, ওই ব্যাঙ্কের লকারের হদিস মিললেও এত দিন তারা সেটি খুলতে পারেনি। কারণ, ওই ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষ ইডি-কে জানান, বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ ইতিমধ্যেই পিয়ালির লকারটি ‘সিজ’ বা বাজেয়াপ্ত করে রেখেছে। সে জন্য তাঁরা ইডি-কে লকার খোলার অনুমতি দিতে পারবেন না। তবে ইডি-র বক্তব্য, ‘প্রিভেনশন অব মনি লন্ডারিং অ্যাক্ট’-এ তারা যে-কোনও পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্কের কাছ থেকে তাদের গ্রাহকের লকারের তথ্য পাওয়ার অধিকারী।

পুলিশি সূত্র জানাচ্ছে, সল্টলেকের গোয়েন্দারা বিধাননগর এসিজেএম আদালতের অনুমতি নিয়ে মঙ্গলবার রাতে ওই ব্যাঙ্কে হানা দেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ভিডিও রেকর্ডিং করে লকারের জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করেন। পুরো কাজটিই হয় ব্যাঙ্ককর্তাদের উপস্থিতিতে। পুলিশের খবর, ২০১৩ সালে মল্লিকা চট্টোপাধ্যায় নামে এক মহিলা সারদার এক এজেন্টের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেন। সেই মামলায় সুদীপ্ত-সহ সারদার বেশ কয়েক জনের নাম ওঠে। সল্টলেক পুলিশের এক কর্তার দাবি, মামলাটির তদন্ত করতে গিয়ে পিয়ালির ওই লকারের হদিস মেলে। সারদা কাণ্ডের তদন্তে নেমে বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পেয়েছিল সল্টলেক পুলিশ। তার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এই শাখাটিও পড়ে। পুলিশ জানতে পারে, ওই লকারে সারদার কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি পাওয়া যেতে পারে। তাই সেটি খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

লকার খুলে জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করার জন্য বিধাননগর পুলিশের পক্ষ থেকে সোমবারেই এসিজেএম আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। আদালত সূত্রের খবর, মঙ্গলবার দু’টি শর্তসাপেক্ষে ওই লকার খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। শর্ত দু’টি হল: ১) লকার খুলে জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করার পুরো প্রক্রিয়া ভিডিওয় তুলে রাখতে হবে। ২) বাজেয়াপ্ত করা জিনিসপত্র পরের দিনই জমা দিতে হবে আদালতে। ইডি সূত্রের খবর, লকার খোলার বিষয়টি মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ চিঠি দিয়ে ইডি-কে জানায় সল্টলেক পুলিশ।

একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কেও পিয়ালির দু’টি লকার রয়েছে। ইডি-র তদন্তকারীদের দাবি, ওই লকার দু’টি বাজেয়াপ্ত করে ইতিমধ্যেই গয়নাগাঁটি ও শেয়ারের নথি উদ্ধার করা হয়েছে। জেরায় পিয়ালি ইডি-কে বলেছেন, সল্টলেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের লকারটিতে আরও অনেক গয়না ও নথিপত্র রাখা আছে। ওই লকারটিও বাজেয়াপ্ত করতে চেয়েছিল ইডি। এ ব্যাপারে ওই ব্যাঙ্কের এক কর্তাকে ইডি-র দফতরে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তবে ইডি-র আগেই এ দিন লকারটি খুলে ফেলে পুলিশ।

একটি খবরের চ্যানেল এবং একটি সংবাদপত্র বিক্রি বাবদ কয়েক কোটি টাকার ড্রাফট জমা পড়েছিল সারদার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। কে ওই চ্যানেল ও সংবাদপত্র কিনেছিলেন, কোন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার মধ্যস্থতায় তা বিক্রি করা হয়েছিল এই সব তথ্য জানতে এ বার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্তাকেও জেরা করতে চাইছেন ইডি-র তদন্তকারীরা।

ইডি সূত্রের খবর, সারদা গোষ্ঠীর মালিকানায় থাকা একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেল এবং একটি সংবাদপত্র বিক্রি করার চুক্তি করেছিলেন সারদা-প্রধান সুদীপ্ত। এই বাবদ তিনি কয়েক কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ড্রাফট নেন। সেই ড্রাফট সারদার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমাও পড়ে। তদন্তকারীদের দাবি, সেই টাকা ওই অ্যাকাউন্ট থেকে এখনও তোলা হয়নি। তদন্তকারীরা ওই টাকার হদিস পেতে চাইছেন। ইডি-র খবর, ওই সংবাদ চ্যানেল এবং সংবাদপত্র শেষ পর্যন্ত পাকাপাকি ভাবে বিক্রি করা হয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট হয়নি। তাই যিনি ওই ড্রাফট দিয়েছিলেন, এই তদন্তে তাঁর নাম জানা প্রয়োজন। সেই জন্যই ব্যাঙ্কের সহায়তা দরকার।

এই তদন্তে সুদীপ্তের প্রথম পক্ষের ছেলে শুভজিৎ সেন এবং পিয়ালিকেও প্রয়োজন বলে ইডি-র দাবি। সেই জন্য মঙ্গলবার দু’জনকে ফের নিজেদের হেফাজতে নিতে আদালতে আবেদন করেছিলেন তদন্তকারীরা। এ দিন ইডি-র দুই আইনজীবী ভাস্করপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিজিৎ ভদ্র আদালতের মুখ্য বিচারক মহম্মদ মুমতাজ খানের কাছে আবেদন জানান, ধৃতদের পাঁচ দিন জেরা করে বেশ কিছু নথি, কয়েকটি লকার এবং বিভিন্ন স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হদিস মিলেছে। গোপন সূত্রে খবর মিলেছে, ওই দুই অভিযুক্তের নামে ও বেনামে আরও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। সেই সব সম্পত্তি চিহ্নিত করা কষ্টকর কাজ। সেই জন্য ওই দুই অভিযুক্তকে আরও দু’দিন নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করতে চায় ইডি। বিচারক দুই অভিযুক্তকে আরও দু’দিন ইডি-র হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। ২৫ এপ্রিল তাঁদের ফের ওই আদালতে হাজির করানো হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement