গোটা দেশেই চলছিল ইউরিয়া সারের সঙ্কট। রাজ্যেও তার ধাক্কা লাগল।
এ রাজ্যের বোরো চাষে ইউরিয়া সার অপরিহার্য। রাজ্যের চাষিরা মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘ইফকো’ উত্পাদিত ইউরিয়া ব্যবহার করেন। রাজ্য কৃষি দফতর অনুমোদিত সার বিক্রতা এবং কৃষি সমবায় সমিতি মারফত তা বাজারে বিক্রি হয়। অন্য সংস্থার ইউরিয়া সার ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন। তবে ইফকো-র ইউরিয়ার দাম অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় চাষিদের কাছে তার চাহিদা বেশি। বোরো চাষে বিঘে প্রতি ২০ কিলোগ্রাম করে ইউরিয়া লাগে।
চারা রোপণ করার সময়ে অর্ধেক, আর বাকি সার দফায়-দফায় প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করেন চাষিরা। চলতি কথায় চাষিরা বলেন ‘চাপান’ সার। প্রথম দফায় তা পাওয়া গেলেও এখন তার অভাব দেখা দিয়েছে সর্বত্র। ফলে ধানের পুষ্টি ও ফলন দু’টোই মার খাবে বলে চাষিদের আশঙ্কা। রাজ্য কৃষি দফতর সূত্রের খবর, মরসুমের শুরুতেই কেন্দ্রীয় সার ও রয়াসন দফতরের কাছে রাজ্যের চাহিদা আগাম জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই মতো, ইফকো এবং অন্য সার উত্পাদক সংস্থাগুলিকে তা সরবরাহ করার নির্দেশ দেওয়ার কথা মন্ত্রকের। কিন্তু এখনও পর্যন্ত চাহিদা অনুযায়ী সার রাজ্য পায়নি।
তার ফল ভুগতে হচ্ছে চাষিদের। শুধু মাত্র হাওড়া জেলার জন্যই দু’হাজার টন ইউরিয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা জানানো হয়েছিল। কিন্তু এসেছে মাত্র ১২০০ টন। ইউরিয়া না পেয়ে চাষিরা ডিএপি সার ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু তাতে বাড়তি খরচ হচ্ছে বলে তাঁদের অভিযোগ। ইউরিয়া সারের দাম যেখানে কিলো প্রতি সাত টাকা, ডিএপি সারের দাম ২৫ টাকা। নদিয়ায় আবার ইউরিয়ার কালোবাজারি শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ।
অন্যান্য রাজ্যের পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম। পঞ্জাব থেকে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান থেকে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ থেকে বিহার সর্বত্র ইউরিয়া সারের জন্য হাহাকার। চলছে কালোবাজারিও। কোথাও দু’গুণ, কোথাও তিন গুণ দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে। উত্তর ভারতের যে সব রাজ্যে গম চাষ হচ্ছে, সে সব জায়গায় আইনশৃঙ্খলার সমস্যা শুরু হয়েছে। চাষিরা কোথাও ট্রেন অবরোধ করছেন, কোথাও সরকারি অফিসে হামলা করছেন। কিছু জায়গায় অবস্থা এতটাই খারাপ যে পুলিশ দাঁড় করিয়ে ইউরিয়ার বস্তা বিলি করতে হচ্ছে। না হলে বস্তা লুঠ হয়ে যাচ্ছে।
কেন এই সঙ্কট?
কেন্দ্রীয় সার ও রসায়ন মন্ত্রী অনন্ত কুমার বলেন, “দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩.০৫ কোটি টন ইউরিয়া প্রয়োজন হয়। কিন্তু গড়ে উত্পাদন হয় ২.২৬ কোটি টন। ফলে বাকি ৮০ লক্ষ টন আমদানি করতে হয়।” মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, ২০১৪ সালে এক সঙ্গে চারটি বড় সার কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দেশে সার উত্পাদন আরও কমেছে। সার আমদানিতে দেরি হওয়ায় সমস্যা আরও বেড়েছে। বিদেশ থেকে জাহাজে আমদানি করা ইউরিয়া আবার পণ্যবাহী রেলের অভাবে ঠিক মতো রাজ্যে-রাজ্যে পৌঁছয়নি। আবার সার কারখানা থেকে বিভিন্ন রাজ্যে ইউরিয়া পাঠানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবহণ ভর্তুকি না থাকার ফলেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গাঙ্গেয় অববাহিকার রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি।
এ দেশে ইউরিয়ার দাম সরকার নিয়ন্ত্রিত। কেন্দ্রীয় সরকার ইউরিয়ায় ভর্র্তুকি দেয়। এক টন ইউরিয়ার সর্বোচ্চ খুচরো মূল্য ৫,৩৬০ টাকা হিসেবে সরকার বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু নেপালের মতো প্রতিবেশী রাজ্যে ইউরিয়ার দাম অনেক বেশি। তাই সীমান্ত পেরিয়েও ইউরিয়া পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সার মন্ত্রকের একাংশ মনে করছেন, বাজারদরে সার বিক্রি করে কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি ভর্তুকি পৌঁছে দিলে চোরাপথে ইউরিয়া রফতানি ও কালোবাজারি দুই-ই বন্ধ হতে পারে।
কেন্দ্রীয় সারমন্ত্রী অনন্ত কুমার দাবি করেছেন, রবি ফসলের জন্য ইউরিয়ার অভাব মিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আগে নিম-যুক্ত ইউরিয়া তৈরির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বসীমা বাঁধা ছিল। এখন তা-ও তুলে দেওয়া হয়েছে। নিম-যুক্ত ইউরিয়া ব্যবহার করলে তা কীটনাশক হিসেবেও কাজ করবে বলে কেন্দ্রের যুক্তি। কেন্দ্রীয় সরকার নতুন ইউরিয়া বিনিয়োগ নীতি এনেছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে যে সব কারখানা তৈরি হবে, সেখানে কেন্দ্র ভর্তুকি দেবে।
তাতে কৃষকদের দুর্দশা মিটছে না। কৃষক সংগঠনগুলির অভিযোগ, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলিতে নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকেই ইউরিয়ার অভাব দেখা দেয়। ৩৫০ টাকা দামের ৫০ কেজির ইউরিয়া ব্যাগ ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি হতে শুরু করে। এর আগে খারিফ মরসুমেও ইউরিয়ার অভাব দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ভয়াবহ আকার নেয়নি। কৃষি মন্ত্রকের আশঙ্কা, ইউরিয়া সরবরাহ ধাক্কা খাওয়ায় গম, আখ, শাক সব্জির উত্পাদন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
মোদী সরকারের নীতি হল, যত সার প্রয়োজন তা দেশে উত্পাদন করা। কিন্তু তার জন্য পাঁচ-ছয় বছর সময় লাগবে। চালু কারখানাগুলির উত্পাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে অভাব মেটানোর চেষ্টা হবে। গোরখপুর, বারাউনি, তালচের, তামিলনাড়ুর রামানুজম, ঝাড়খণ্ডের সিন্ধ্রির বন্ধ কারখানাগুলি চালুর চেষ্টা হচ্ছে। সিন্ধ্রির কারখানা থেকেই মূলত পশ্চিমবঙ্গে ইউরিয়া সরবরাহ করা হত। কিন্তু চলতি সঙ্কট কী ভাবে মিটবে, তার নির্দিষ্ট সূত্র এখনও মেলেনি।