ইউরো-কর্তার মুখে শুধু মনে নেই, জানি না

ধরা পড়ার পরে বিচারকের মুখোমুখি হয়েই ইউরো-কর্তা বিশ্বপ্রিয় গিরি স্বীকার করেছিলেন, তাঁদের অর্থ লগ্নি সংস্থা অন্তত ছ’কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছে। কিন্তু পুলিশি হাজতে ফিরেই পুরোপুরি বদলে গিয়েছে তাঁর আচরণ। পুলিশি সূত্রের খবর, তদন্তে কোনও রকম সহযোগিতা করছেন না ইউরো-কর্তা। একেবারে মুখে কুলুপ না-আঁটলেও তদন্তকারীদের প্রশ্নের মুখে ‘মনে নেই’, ‘জানি না’ গোছের দায়সারা জবাব দিচ্ছেন বিশ্বপ্রিয়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৭
Share:

ধরা পড়ার পরে বিচারকের মুখোমুখি হয়েই ইউরো-কর্তা বিশ্বপ্রিয় গিরি স্বীকার করেছিলেন, তাঁদের অর্থ লগ্নি সংস্থা অন্তত ছ’কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছে। কিন্তু পুলিশি হাজতে ফিরেই পুরোপুরি বদলে গিয়েছে তাঁর আচরণ। পুলিশি সূত্রের খবর, তদন্তে কোনও রকম সহযোগিতা করছেন না ইউরো-কর্তা। একেবারে মুখে কুলুপ না-আঁটলেও তদন্তকারীদের প্রশ্নের মুখে ‘মনে নেই’, ‘জানি না’ গোছের দায়সারা জবাব দিচ্ছেন বিশ্বপ্রিয়।

Advertisement

ধৃত ইউরো-কর্তার কাছ থেকে সহযোগিতা না-পেলেও বিধাননগর পুলিশ রবিবার দক্ষিণ কলকাতার একাধিক জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি উদ্ধার করেছে। তার মধ্যে আছে বিশ্বপ্রিয়র পাসপোর্ট-সহ নানান তথ্য এবং জমি সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র। তদন্তে রাজারহাট সংলগ্ন এলাকায় কয়েকটি জমিরও হদিস মিলেছে।

সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার পরে অন্য যে-সব বেসরকারি লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে বেআইনি ভাবে টাকা তোলার এবং তা ফেরত না-দেওয়ার অভিযোগ উঠছিল, ইউরো গ্রুপ অব কোম্পানিজ তার অন্যতম। এত দিন ওই সংস্থার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, সেই প্রশ্ন উঠছে। রেবা মজুমদার নামে দমদমবাসী এক মহিলা (ইউরোর এজেন্ট)-র অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার রাতে সল্টলেকের পাঁচ নম্বর সেক্টর থেকে গ্রেফতার করা হয় ইউরোর অন্যতম কর্ণধার বিশ্বপ্রিয়কে।

Advertisement

বিধাননগরের এসিজেএম অপূর্বকুমার ঘোষ শনিবার বিশ্বপ্রিয়কে প্রশ্ন করেন, ইউরো বাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলেছে বলে শোনা যাচ্ছে। ইউরো-কর্তা হিসেবে তিনি কী বলেন? বিশ্বপ্রিয় অত টাকা তোলার কথা মানতে চাননি। তাই ওই সংস্থা ঠিক কত টাকা তুলেছে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই গিয়েছে। আদালত ধৃতকে ১১ দিন পুলিশি হাজতে রাখার নির্দেশ দেয়।

আদালত থেকে ফেরার পরে বিশ্বপ্রিয় আর তদন্তে সাহায্য করছেন না বলে পুলিশের অভিযোগ। তারা জানায়, হেফাজতে নিয়ে জেরা পরে কোনও প্রশ্নেরই সদুত্তর দিচ্ছেন না ইউরো-কর্তা। কখনও প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন। কখনও বা বলছেন ‘জানি না’, ‘মনে নেই’ ইত্যাদি। যেমন, রাজারহাট এলাকায় ইউরো গ্রুপের একাধিক জমির খোঁজখবর পেয়েছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু ওই সব জমির ব্যাপারে বিশ্বপ্রিয় কোনও তথ্য দিচ্ছেন না তিনি। অথবা এমন জবাব দিচ্ছেন, যাতে ধোঁয়াশা বেড়েই যাচ্ছে। এমনকী ওই সব জমির নথিপত্র কোথায় রয়েছে, ইউরো-কর্তার কাছে তারও সদুত্তর পাননি তদন্তকারীরা।

কেন তদন্তে সহযোগিতা করছেন না ইউরো-র অন্যতম কর্ণধার?

পুলিশের খবর, বিশ্বপ্রিয় এই প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের সংস্থায় আরও কিছু অধিকর্তা আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না-নিয়ে শুধু তাঁকেই গ্রেফতার করা হল কেন? অন্যদের ছেড়ে তাঁকেই ধরায় তিনি তদন্তে সহযোগিতা করছেন না। তবে জেরায় বিশ্বপ্রিয়র দাবি, তাঁর নামে কোনও সম্পত্তি নেই। ইতিমধ্যে ইউরোর আরও কয়েক জন অধিকর্তার সম্পর্কে তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা।

পুলিশ জেনেছে, বাংলা ছাড়াও বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ডের মতো বিভিন্ন রাজ্যে ইউরো গোষ্ঠীর ব্যবসা ছড়ানো ছিল। এ-পর্যন্ত ৬০০ কোটি টাকা তোলা হয়েছিল বলে এজেন্টদের সূত্রে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন। তদন্তে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ টাকাই তোলা হয়েছে উত্তরপ্রদেশ ও বিহার থেকে। ভিন্ রাজ্যে গিয়ে ইউরোর সম্পত্তি এবং আমানত সংগ্রহের বিষয়ে কী ভাবে তথ্য জোগাড় করা যায়, বিধাননগরের পুলিশকর্তারা এখন সেটাই খতিয়ে দেখছেন।

সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, সব বেসরকারি অর্থ লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই ঘোষণার পরেও রাজ্য পুলিশের তদন্তে দেখা যাচ্ছে, সিলিকন, ইউরোর মতো লগ্নি সংস্থা দেদার ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন আগেই কেন ওই সব সংস্থার ব্যবসা বন্ধে উদ্যোগী হয়নি, প্রশ্ন তুলছেন আমানতকারীরা।

সারদা-সহ বিভিন্ন অর্থ লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের দাবিতে যাঁরা সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন, প্রশ্নটা তাঁদেরও। শীর্ষ আদালতে আবেদনকারীদের অন্যতম অমিতাভ মজুমদার বলেন, “এখানেও (ইউরো) কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোতে পারে। এখানেও মিলতে পারে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের খোঁজ।” তাই তাঁর দাবি, রাজ্য পুলিশের তদন্তের সঙ্গে সঙ্গে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি এবং সিবিআইয়েরও তদন্তের আওতায় আনা হোক ইউরোকে।

মাতঙ্গ পিজিতে

জামিনের আবেদন খারিজ হওয়ার পরে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহকে শনিবার সিবিআইয়ের হেফাজতে ফিরতে হয়েছিল। রবিবার জেরা শুরু হওয়ার পরে ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। স্থগিত হয়ে যায় জেরা পর্ব। সন্ধ্যায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। কিছু পরীক্ষার পরে ভর্তি করিয়ে নেওয়া হয় উডবার্ন ওয়ার্ডে। সারদা কেলেঙ্কারিতে ৩১ জানুয়ারি গ্রেফতারের পরে মাতঙ্গকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। শনিবার আলিপুর আদালত তাঁকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিবিআই হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয়। রবিবার সকালে জেরা শুরু হওয়ার পরে অসুস্থ বোধ করেন মাতঙ্গ। পরীক্ষার পরে চিকিৎসকেরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তদন্তকারীরা তা মেনে নেন। বিকেলে মাতঙ্গের আইনজীবী সেলিম রহমান সিবিআই দফতরে গেলে তাঁকে প্রাক্তন মন্ত্রীর অসুস্থতার খবর দেওয়া হয়। আইনজীবী বলেন, “জেরা পর্বে হাজির থাকার জন্যই সিবিআই দফতরে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার মক্কেলের অসুস্থতার খবর পাই। তদন্তকারীরা বললেন, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement