সংবাদপত্রে প্রকাশিত সারদার বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে এক জনসভায়। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
এ বার সরাসরি কংগ্রেস শীর্ষ নেতা আহমেদ পটেলের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ আনলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড় ও সবংয়ের দুই সভাতেই সনিয়া গাঁধীর রাজনৈতিক সচিবের নাম উল্লেখ করে তাঁর অভিযোগ, আহমেদের বাড়িতে কংগ্রেস ও সিপিএমের কয়েক জন নেতা মিলে জেলাশাসক, পুলিশ সুপার এবং ওসি-আইসি’র বদলির তালিকা তৈরি করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে ভিত্তিহীন বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। আহমেদ নিজেও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রদেশ নেতৃত্ব আজ, বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে বিধিভঙ্গের নালিশ জানাবে।
লোকসভা ভোট পরিচালনার কাজে মূলত শাসক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে প্রথম দফায় গত ৭ এপ্রিল এ রাজ্যের এক জন জেলাশাসক, দু’জন অতিরিক্ত জেলাশাসক এবং পাঁচ জন পুলিশ সুপারকে সরিয়ে দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। একই কারণে দ্বিতীয় দফায় মঙ্গলবার বিভিন্ন জেলার ২০ জন পুলিশ অফিসার এবং তিন জন বিডিও-কে সরিয়ে দিয়েছে কমিশন। মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের প্রতিক্রিয়া তারই প্রেক্ষিতে।
এ দিন কী বলেছেন মমতা? নারায়ণগড় এবং সবং, দু’জায়গাতেই বদলি প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “এর পিছনে মূলত সিপিএম এবং কংগ্রেসের ষড়যন্ত্র রয়েছে।” তাঁর দাবি, “জঙ্গলমহল হাসছে। এখন বাংলায় রাজনৈতিক খুন হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, কংগ্রেস ও সিপিএমের কিছু নেতা দিল্লিতে আহমেদ পটেলের বাড়িতে বসে ডিএম, এসপি, ওসি, আইসি-দের বদলির তালিকা তৈরি করছেন।” মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, “এসপি বদলে হয়নি, এখন ওসি বদল করতে হল। পুলিশ ভোট দেয়, না রিগিং করে? পুলিশ কি ভোটটা করিয়ে দেবে? এত অবিশ্বাস! পুলিশ আইনশ্ৃঙ্খলা সামলায়। আমরা মানুষের ভোটে জিতি।”
মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি আহমেদ পটেলের নাম করায় অনেকেই মনে করছেন, আসলে নিশানা কংগ্রেস হাইকম্যান্ড তথা সনিয়া গাঁধী। মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে দীপা দাশমুন্সির হয়ে প্রচারে রাজ্যে এসে সনিয়া সারদা প্রসঙ্গ তুলে তৃণমূল সরকার ও শাসকদলকে বিঁধেছেন। তার পরেই মমতার এ ভাবে আহমেদ পটেলের নাম টেনে আনা তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন অনেকে।
নারায়ণগড়ের সভায় মুখ্যমন্ত্রী
আহমেদ নিজে সংবাদসংস্থাকে বলেছেন, “কোথাও কোনও ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে মনে হয়। পশ্চিমবঙ্গ বা অন্য কোথাও কোনও আধিকারিক বদলের ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। আমি এত ক্ষমতাবান নই। যদি তা-ই হতাম, তা হলে নিজের এলাকায় এক আধিকারিককে বদলি করার দাবিতে আমাকে অনশনে বসতে হতো না।” তাঁর বাড়িতে সিপিএম-কংগ্রেস নেতাদের বৈঠকের কথা তিনি খারিজ করে দিয়েছেন।
কংগ্রেসের আর এক কেন্দ্রীয় নেতা শাকিল আহমেদ মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করে বলেছেন, “এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে মমতা কতটা চাপে রয়েছেন।” তাঁর আরও বক্তব্য, এই অভিযোগ তোলার অর্থ প্রকারান্তরে কমিশনকেই প্রশ্নের মুখে ফেলা। কমিশনের তাই উচিত বিষয়টি খতিয়ে দেখা।
প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কমিশনে নালিশ জানাতে যাবেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কটাক্ষ, “সারদার খাঁড়া থেকে বাঁচতে এক জন রাজনীতিক উন্মাদের মতো কথা বলছেন। তাঁর রাজনৈতিক অস্ত্র যে-হেতু দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, তাই তিনি চাইছেন নির্বাচন কমিশন যাতে তাঁকে শাস্তি দেয়।” কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ বলেন, “এতই যখন জানেন, কারা কারা বসে ঠিক করেছে সেটাও বলে দিন।” কংগ্রেস নেতৃত্ব বোঝাতে চেয়েছেন, তৃণমূল নেত্রীর বিরুদ্ধে কমিশন কোনও কড়া ব্যবস্থা নিলে, তার থেকে সহানুভূতির ফায়দা তোলার চেষ্টা করবেন মমতা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব বলেন, “এখন ইডি সারদাকাণ্ডে তদন্ত করছে। তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে এ সব বলছেন। এর পর সিবিআই এলে কী করবেন!”
শুধু কমিশনের নির্দেশপ্রাপ্ত অফিসারদের তালিকা কোথায় তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে মন্তব্য করাই নয়, বদলি হওয়া অফিসারদের নিয়েও তিনি বলেন, “এরা সবই তো আমার লোক।
রাজ্যের মধ্যেই তো বদলি হবে। দিল্লি থেকে তো আর এসপি, ওসি আসবেন না।” যাঁদের সরানো হয়েছে, তাঁদের আশ্বস্ত করে এবং কমিশনকে সমালোচনা করে মমতা বলেন, “তুমি যাকে অপমান করবে, আমি তাকে সম্মান দেব। সসম্মানে কাজ করাব। আমার চোখে কেউ খারাপ নয়। আমার সব সরকারি কর্মচারী ও অফিসার ভাল। ১৫ দিনে কী আসে যায়! ঘুরে বেড়াবে। আরাম করবে।”
নারায়ণগড়ে প্রার্থীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী
এই মন্তব্যেরও তীব্র সমালোচনা করেছেন বিরোধীরা। সিপিএমের অভিযোগ, “ক্ষমতায় আসার আগে তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল, দলতন্ত্রের বদলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন। এখন পুলিশ-প্রশাসনের আধিকারিকদের সরাসরি আমাদের লোক বলে তাঁদের দলদাস বানাতে চান মুখ্যমন্ত্রী।” দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবের বক্তব্য, “সংবিধানের ৩২৪ নম্বর ধারা মেনে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। ভোট ঘোষণার পর থেকে পুলিশ-প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ যে কমিশনের হাতেই, তা কারও অজানা নয়। অথচ, মুখ্যমন্ত্রী একের পর এক মন্তব্য করে কমিশনের এক্তিয়ারকে অস্বীকার করছেন!” সরকারি আধিকারিকরা মানুষের করের টাকায় বেতন পান, এটা মুখ্যমন্ত্রী ভুলে গিয়েছেন বলে কটাক্ষ করেন প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। বিজেপি-র অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী আত্মবিশ্বাস হারিয়ে এমন মন্তব্য করছেন। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “ওঁরই যখন সব পুলিশ, তা হলে এত প্রতিবাদের কী দরকার!”
কমিশনের অফিসার বদলিও যেমন নতুন নয়, তেমনই মমতার কমিশন-বিরোধিতাও পুরনো। গত ৭ এপ্রিল ডিএম, এডিএম এবং এসপিদের বদলি নিয়ে মমতা মন্তব্য করেছিলেন, “যারা নতুন পোস্টিং পেল, তারাও তো আমারই অফিসার। প্রত্যেকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। তারাও তো আমার হয়েই কাজ করবে, মানে স্বচ্ছ (ভাবে) নির্বাচন (পরিচালনা) করবে।” এ বারে মমতার সঙ্গে এই প্রচারে যোগ দিয়েছেন অন্য নেতা-মন্ত্রীরাও। এক জনসভায় খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “সব কিছুর তো একটা লিমিট আছে নাকি! নির্বাচন কমিশন যদি অন্যায় করে, তা হলেও কিছু বলা যাবে না! এ বিষয়ে একটা বিতর্ক হওয়া উচিত। এত ক্যামেরা না পাঠিয়ে আমাদের বললেই তো হয়, কমিশনের কাছে আমরা বক্তব্যের ভিডিও তুলে দিতে পারি।”
কমিশন সূত্রে খবর, নির্বাচনের কাজে থাকা কোনও সরকারি অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সংশ্লিষ্ট অফিসারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের আগে অভিযোগ খতিয়ে দেখেন কমিশন-নিযুক্ত পর্যবেক্ষক এবং জেলা প্রশাসন। তাঁরা রিপোর্ট দিয়ে অভিযোগ ঠিক বলে জানালে তবেই ওই অফিসারকে বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে তাই প্রশাসনের একটি অংশ প্রশ্ন তুলেছে, মুখ্যমন্ত্রী কি তবে নিজের প্রশাসনের দেওয়া রিপোর্টকেই অস্বীকার করছেন?