ঘুঘড়াগাছিতে জমি দখলে গুলিচালনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার কৃষ্ণগঞ্জের খালবোয়ালিয়া মোড়ে পথসভা করলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
উদভ্রান্তের মতো ওষুধের দোকান ও চিকিৎসকের কাছে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন উত্তম তরফদার। তাঁর স্ত্রী শ্যামলী তরফদার কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি। রবিবার সকালে কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছি গ্রামে জমি দখল কেন্দ্র করে গোলমালে দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলি বিঁধেছিল শ্যামলীদেবীর চোয়ালে। চোয়াল ফুলে গিয়েছে। কথা বলতে গেলেই যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠছেন ওই বধূ। জরুরি বিভাগের সাত নম্বর শয্যায় শুয়ে কোনওমতে তিনি বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। কারও ক্ষতি করিনি। তবুও কেন এমন শাস্তি পেতে হল?” অসহায় উত্তমবাবু বলছেন, “দিনমজুরি করে কোনও মতে সংসার চলে। সরকারি কোনও সাহায্য পাচ্ছি না। বহু ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। কী ভাবে স্ত্রীর চিকিৎসা চালাব বুঝতে পারছি না।”
যে জমি নিয়ে এই গোলমাল সেই জমি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে শ্যামলীদেবীর বাড়ি। রবিবার সকালে গুলি ও বোমার আওয়াজ পেয়ে ওই মহিলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি গুলি এসে লেগেছিল চোয়ালে। প্রথমে তাঁকে কৃষ্ণগঞ্জ গ্রামীণ হাসপাতাল ও পরে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় পরে তাঁকে নিয়ে আসা হয় কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সোমবার তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে আনা হয়। উত্তম বলছেন, “গরিবকে এ ভাবে মেরে কার কী লাভ হল বলুন তো? চিকিৎসকেরা বলেছেন প্লাস্টিক সার্জারি করতে হবে। অনেক টাকা লাগবে। কোথা থেকে পাব এত টাকা? ভাবতে ভাবতে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়।” আতান্তরে পড়েছে ঘুঘড়াগাছির রাজীব মণ্ডলের পরিবার। স্বর্ণখালি হাই স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাজীবও গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। মঙ্গলবার বিকেলে শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল থেকে তাকে পাঠানো হয়েছে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু রাত পর্যন্ত তাকে সেখানে ভর্তি করাতে পারেনি বাড়ির লোকজন। রাজীবের বাবা, পেশায় দিনমজুর রাজকুমারবাবু বলছেন, “এখানে বলছে শয্যা নেই। চিকিৎসকেরা বলছে, অন্য কোথাও নিয়ে যেতে। এই রাতে কী করব, ছেলেকে কোথায় নিয়ে যাব কিছুই বুঝতে পারছি না।” রাজীব বলছে, “সেদিন এলোপাথাড়ি গুলি চলেছিল। একটি গুলি ছিটকে এসে লাগে আমার ডান পায়ে। এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতাল দৌড়ঝাঁপ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।”
ঘুঘড়াগাছিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন লতিকা তরফদার নামে আরও এক গ্রামবাসী। তাঁকে অবশ্য মঙ্গলবার শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর যিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন সেই অপর্ণা বাগের মেয়েরা আজও আফশোস করছেন, “সে দিন যদি জোর করে কোনও ভাবে মাকে আটকে পারতাম তাহলে হয়তো এমনটা ঘটত না।” অপর্ণাদেবীর বড় মেয়ে নীলিমা ও ছোট মেয়ে দেবীকা জানায়, সে দিন জমি দখল হয়ে যাচ্ছে শুনে অপর্ণাদেবী দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময় দুই মেয়ে তাঁকে আটকায়। কিন্তু তাদের সরিয়ে দিয়ে ‘জমি চলে গেলে খাব কী’ বলতে বলতে সেই ট্রাক্টরের দিকে এগিয়ে যান তিনি। নীলিমা ও দেবীকার কথায়, “মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই গুলি ও বোমের শব্দ শুনতে পেয়ে আমরাও বেরিয়ে যাই। দূর থেকে দেখি, মায়ের রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে রয়েছে। অথচ ওই গুলি-বৃষ্টির মধ্যে দীর্ঘ সময় মায়ের কাছে ঘেঁষতে পারিনি। রাতে ঘুমোতে পারছি না। ঘুমের মধ্যেও গুলির শব্দ শুনে চমকে উঠছি। যারা এমন করল তাদের যেন কঠোর শাস্তি হয়।” অপর্ণাদেবীর স্বামী পেশায় ভ্যান চালক দিবানন্দবাবু বলছেন, “এই সামান্য আয়ে গোটা সংসারটা হিসেব করে চালাত অপর্ণাই। ও চলে যাওয়ায় সংসারটাই ভেসে গেল।” আহদের পরিবারের আক্ষেপ, ঘটনার পরে বামফ্রন্ট, বিজেপি ও কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা গ্রামে গিয়ে আহত ও নিহতদের বাড়ি গিয়েছিলেন। আর শাসক দল, তৃণমূল পরিবারের সঙ্গে দেখা করা তো দূরের কথা, গ্রামেই ঢোকেনি। এ দিকে কলকাতায় এসে অসহায় হয়ে পড়েছেন আহতদের পরিবারের সদস্যরা। কলকাতায় তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি কোনও দলই। উত্তমবাবু বলছেন, “একেবারে অপরিচিত জায়গা। কেউ একটু পাশে দাঁড়ালেও ভরসা পেতাম।” মঙ্গলবার দিবানন্দবাবু নতুন করে নয় জনের বিরুদ্ধে কৃষ্ণগঞ্জ থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় দীপঙ্কর বিশ্বাস নামে এক বাসিন্দা পুলিশের কাছে ছ’জনের নামে এফআইআর করেন।