মাত্র দেড় মাস, আমুল বদলে গিয়েছে এলাকাটা।
বাইরের গেটে তালা। বন্ধ ঘরগুলি ধুলো-নোংরায় ভর্তি। পেল্লায় যন্ত্রগুলি দেখভালের অভাবে মরচে পড়ছে। এ হাল বারাসতের সুভাষনগরে কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদিত রাজ্যের একমাত্র ইনট্রিগেটেড প্যাক-হাউসটির।
অথচ একেবারেই উল্টো ছবি তার ঠিক পাশের বেসরকারি প্যাক-হাউসে। ৮-১০টা ট্রাকে বোঝাই করে সবজি ও ফল ঢুকছে সেখানে। চাষিরা আসছেন। ঝকঝকে প্যাক-হাউসে সবজি ও ফল পরিষ্কার করে দেখে নিচ্ছেন কর্মীরা। কন্টেনারে এ রাজ্যের ফল, সবজি চলে যাচ্ছে বিদেশে। এলাকা গমগম করছে।
এক দিকে পরিকাঠামোজনিত নানা অসুবিধা। আর অন্য দিকে, এলাকার ছেলেদের কাজে নিতে হবে এই রোষের মুখে সরকারি প্যাক-হাউস থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি সংস্থার প্যাক-হাউসে সবজি ও ফল রাখতে বাধ্য হয়েছেন রফতানিকারীরা। এর জন্য রফতানিকারীদের দিতে হচ্ছে বেশি পয়সা, সরকার প্যাক-হাউসটির ভাড়া পাচ্ছে না। এই কথা জানিয়ে বছরখানেক ধরে মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানপালন দফতরের দ্বারস্থ হন রফতানিকারীরা। পরে বাধ্য হয়েই ১৫ ডিসেম্বর থেকে বেসরকারি প্যাকহাউসেই ফল-সবজি রাখতে শুরু করেন রফতানিকারীরা।
রাজ্যে ১৫ রফতানি সংস্থার সংগঠন ওয়েস্টবেঙ্গল ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সম্পাদক মৃণাল সিংহ এ দিন বলেন, “সরকারি প্যাক-হাউস ঠিক করার জন্য বারবার জানালেও কাজ হয়নি। রাজ্যে আর সরকারি প্যাক-হাউসও নেই। কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেবে বলেছে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানপালন দফতর শুধু প্যাক-হাউসের দুরবস্থার রিপোর্টটা পাঠাবে। এটুকুই হচ্ছে না। আমাদের কথা রাজ্য সরকার ভাবছেই না।”
কী বলছেন মন্ত্রী?
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানপালন দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, “প্যাক-হাউস বিষয়ে আলোচনা চলছে।” আগেও এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে একই কথা বলেছেন কৃষ্ণেন্দুবাবু। আপনি তো অনেক দিন ধরেই এই কথাই বলছেন বলায় তাঁর জবাব, “দফতরের অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে নিন।” গত কয়েকমাস ধরে এই ভাবেই শুধু ‘আলোচনা’ই চলছে বলে অভিযোগ রফতানিকারীদের।
এ দিকে, গোটা বিশ্বের বাজারে এই রাজ্যের সবজি ও ফলের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি মাসে ৮ কোটি টাকার ৫ লক্ষ কিলো সবজি ও ফল রফতানি হয় এই রাজ্য থেকে। রাজ্যের ওই ১৫ জন রফতানিকারক ছয় হাজার চাষির কাছ থেকে ফল-সবজি কিনে নেন। আলু-পিঁয়াজ বাদ দিয়ে সব সবজি, শাক, ও ফল পৌঁছে যায় ইউরোপ, আরব-সহ গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
আগে নিজস্ব হিমঘর থেকে রফতানি করতেন ব্যবসায়ীরা। বছর খানেক আগে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (যারা বিদেশে রফতানির করা মালের মান দেখভাল করে) জানিয়ে দেয়, কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রক অনুমোদিত ‘ইনট্রিগেটেড প্যাক-হাউস’ ছাড়া কোনও ভাবেই রফতানি করা যাবে না। কারণ, সবজি ও ফলের মতো পচনশীল মাল প্যাক-হাউসের মাধ্যমেই বিজ্ঞানসম্মত ভাবে সংরক্ষণ ও রফতানি সম্ভব। রাজ্যে এ রকম একমাত্র প্যাক-হাউসটি রয়েছে বারাসতেই। ২০০৭ সালে বারাসতের সুভাষনগরে রাজ্য সরকারের দেওয়া প্রায় ১২ কাঠা জমিতে কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রকের এগ্রিকালচারাল প্রসেস ফুড এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (অ্যাপেডা) প্যাক-হাউস তৈরি করে। দেখাশোনার দায়িত্ব পায় রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানপালন দফতর।
গত বছর ১ এপ্রিল রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যান পালন দফতর থেকে প্যাক-হাউসটি ভাড়া নেয় রফতানিকারকেরা। এর পরেই শুরু বিপত্তির। রফতানিকারক অঙ্কুশ সাহা বলেন, “ওই দফতর মাসে সিকিউরিটি বাবদ ৪৭ হাজার, বিদ্যুত্ বাবদ ২৫ হাজার ছাড়াও ৪৫ হাজার টাকা ভাড়া চায়। ভাড়া নিয়ে দেখা যায়, পরিচর্যা ও দেখভালের অভাবে প্যাক-হাউসটির হিমঘরের বাতানুকূল যন্ত্র থেকে শুরু করে অন্য যন্ত্রপাতি সব খারাপ। মেঝের সিমেন্ট উঠে ইট বেরিয়েছে। ছাদ দিয়ে জল পড়ছে। কিছু মালপত্র চুরিও হয়ে গিয়েছে।”
বাধ্য হয়েই রফতানীকারী ৪ লক্ষ টাকা খরচ করে কিছুটা সংষ্কার করে ২৩ মে সরকারি প্যাক-হাউস থেকে কাজ শুরু করেন। কিন্তু সেখানে আর কিছু রাখা যাচ্ছে না। রফতানিকারীদের বক্তব্য, তার উপরে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের চাপে এলাকার ১৪ জনকে মাইনে দিয়ে কাজে রাখতে হচ্ছিল। ওই কর্মীদের প্রশিক্ষণ নেই। তাই তারা বেসরকারি প্যাক-হাউসের দিকে পা বাড়িয়েছেন। বেসরকারি প্যাক-হাউসে জুতো খুলে হাত পরিষ্কার করে ভিতরে গিয়ে দেখা গেল, তখন পান বাছাই করে প্যাকিং চলছে। ঝকঝকে মেঝে, কোথাও একটুকুও ময়লা নেই। দিনে ১০-১২ বার পরিষ্কার করা হচ্ছে বলে দাবি করলেন ম্যানেজার উত্তম দাস। এমনিতেই বাতানুকূল ঘরগুলি, তার পরও যাতে পোকা ঢুকতে না পারে সে জন্যরয়েছে নানারকমের আলো ও ‘ফ্লাই ক্যাচার’। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিজ্ঞানে স্নাতক ছেলেরা অ্যাপ্রন, মুখোস আর দস্তানা পড়ে কাজ করছেন।
সেখানে আসা রফতানিকারীদের অভিযোগ, ‘গরম লাগে’ অজুহাতে এমন অ্যাপ্রন আর দস্তানা পরে থাকতে চাইত না সরকারি প্যাক-হাউসে কাজে নেওয়া তৃণমূলের সেই ছেলেরা।