কলকাতা ও জেলার সব নাট্যদলকে এক ছাতার তলায় আনার ডাক দিয়েছিলেন তাঁরা। ঠিক দু’বছর বাদে ছিটকে গেলেন এ রাজ্যে শাসক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত দু’জন নাট্যব্যক্তিত্ব। পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসু ও সাংসদ অর্পিতা ঘোষ।
রাজ্যের কয়েকশো নাট্যদলের সম্মিলিত মঞ্চ নাট্যস্বজনের সভাপতির পদ থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্রাত্য বসু ইস্তফা দিয়েছেন। এ দিন রাতে ব্রাত্যর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি বিকেলে নাট্যস্বজনের এগ্জিকিউটিভ কমিটির কয়েক জন সদস্যকে চিঠি দিয়ে পদত্যাগ করেছি।” কেন? ব্রাত্যর জবাব, “কারণটা ব্যক্তিগত। একটা বন্ধুত্বের জায়গা থেকে নাট্যস্বজনের সূত্রপাত হয়েছিল। সেটা আর নেই।” পাশাপাশি নাট্যস্বজন-এর অন্যতম সাধারণ সম্পাদক অর্পিতা ঘোষও এ দিন রাতে বলেছেন, “আমিও ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। কালই (শুক্রবার) ইস্তফা দেব।”
ঘটনাটা একেবারে আকস্মিক নয়। বিসংবাদের জল গড়াতে শুরু করেছিল মঙ্গলবার থেকে। ওই দিন ইস্তফা দেন নাট্যস্বজন-এর অন্যতম সাধারণ সম্পাদক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। তারও বেশ কিছু দিন আগে স্বজন ছেড়েছিলেন মণীশ মিত্র। স্বজনের কাজকর্ম সম্পর্কে বিষোদ্গারও করেছিলেন। কিন্তু সংসারে এতটা ফাটল যে ধরেছে, সেটা বোঝা যায়নি তখন। ব্রাত্য-অর্পিতা একসুরেই কথা বলেছিলেন।
কিন্তু ছবিটা দৃশ্যতই বদলাতে শুরু করে মঙ্গলবারের পর। দেবেশ পরপর নাট্যস্বজন, নাট্য অ্যাকাডেমি এবং মিনার্ভা রেপার্টরি ছেড়ে দেন। মিনার্ভায় আসন্ন নাট্যোৎসব থেকে তাঁর নাটকও তুলে নেন। যদিও প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। ঘনিষ্ঠ মহলে অর্পিতা বলেছিলেন, ‘বন্ধুরা নাট্যস্বজন ছেড়ে দিচ্ছেন, ভাল লাগছে না।’ নাট্যস্বজন যে ভাঙার মুখে, সেটা ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। তৃণমূলের অন্দরে খবর, এ দিন ব্রাত্য নিজে মুখ্যমন্ত্রীকেও পরিস্থিতির কথা জানান। স্বজন থেকে নিজের পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট অভিমত না জানিয়ে বিষয়টি ব্রাত্যর উপরেই ছেড়ে দেন বলে খবর। তবে এ দিন রাত অবধি অর্পিতা অবশ্য জানতেন না, ব্রাত্য নিজে ইস্তফা দিয়েছেন।
অন্য দিকে, এ দিন এবিপি আনন্দের অনুষ্ঠানে প্রায় একযোগে মুখ খুলতে দেখা যায় দেবেশ-মণীশ এবং অর্পিতাকে। সেখানেই সংস্থার মধ্যে একনায়কতন্ত্র এবং স্তাবকতার প্রসারের অভিযোগ উঠে আসে। কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও পরোক্ষ ভাবে অভিযোগের আঙুল ওঠে ব্রাত্যর দিকে।
অর্পিতা বলেন, “আমি নাট্যস্বজনে থাকব না। কারণ, আমার বন্ধুদের এক ধরনের একনায়কতন্ত্রের চাপ সহ্য করতে হচ্ছে। অযোগ্য-স্তাবকদের ভিড় বাড়ছে। আমার নাম করে ভয় দেখানো হচ্ছে জেলার নাট্যদলগুলোকে। যা মেনে নিতে পারছি না।” আগামী ১৭ জানুয়ারি থেকে মিনার্ভায় শুরু হতে চলা নাট্যোৎসব থেকেও তাঁর দলের নাটক তুলে নেন অর্পিতা। ঘটনাচক্রে নাটকটি ব্রাত্যরই লেখা। তবে অর্পিতা জানিয়ে দেন, মিনার্ভা কমিটি এবং নাট্য অ্যাকাডেমি ছাড়ছেন না তিনি। ব্রাত্যও সরকারি কমিটিগুলি থেকে নিজেকে সরানোর কথা বলেননি।
দেবেশ অবশ্য দাবি করেন, “নাট্য অ্যাকাডেমি বা মিনার্ভা রেপার্টরিতেও ব্রাত্য তাঁর স্তাবক গোষ্ঠী তৈরি করে প্রভাব বিস্তার করছেন। সৃজনশীল কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।”
নাট্যস্বজনের বাইরে থাকা নাট্যপরিচালক কৌশিক সেনও নাম না-করে বলেন, “তৃণমূল নিজে নাট্যজগতে ততটা প্রভাব বিস্তার হয়তো করতে চায়নি। কিন্তু শাসক দলের নেতা-নাট্যকর্মীদের মধ্যেই কেউ নাট্যজগতে তাঁর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছেন। এ তারই ফল।” ব্রাত্যর ইস্তফার খবর শুনে তাঁর কটাক্ষ, “প্রহসন মনে হচ্ছে। উনিই তো নাট্যকর্মীদের মধ্যে, বন্ধুদের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়েছেন নানা ভাবে।”
তৃণমূলী বলে পরিচিত নাট্যস্বজনে অন্তর্দ্বন্দ্ব এমন সময়ে সামনে এল, যখন নানা বিষয়ে শাসক দল নিজে কোণঠাসা। অর্পিতা বা ব্রাত্য যে হেতু সাংসদ-মন্ত্রী, তাই এ দিন বিভিন্ন মহলে জল্পনা শুরু হয়ে যায় এ বার ওঁরা তৃণমূলও ছাড়বেন কি না। অর্পিতা অবশ্য এমন সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন। আর ব্রাত্যর দাবি, “নাট্যস্বজন কোনও রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। তাই নাট্যস্বজন থাকুক, না থাকুক রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়বে না।” স্বজন সূত্রের খবর, এই বিরোধ একান্তই ব্যক্তিগত সংঘাত। এর সঙ্গে তৃণমূলের যোগ নেই। স্বজন-ঘনিষ্ঠদের প্রশ্ন, এত অসন্তোষ থাকলে অর্পিতা-দেবেশরা এত দিন কী করছিলেন?
দু’বছর আগে নাট্যব্যক্তিত্ব বিমল চক্রবর্তীর উপরে তৃণমূল কর্মীদের হামলার ঘটনায় পথে নেমেছিলেন বামমনস্ক কয়েক জন নাট্যকর্মী। তার অব্যবহিত পরেই পাল্টা সংগঠন গড়ার ডাক দেন ব্রাত্য-অর্পিতারা। সেখান থেকেই নাট্যস্বজনের পথ চলা শুরু। কিন্তু শহরে এবং জেলায় নাট্যদলগুলির মধ্যে বৈষম্য এবং স্বজনপোষণ সংক্রান্ত নানা অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই জমা হচ্ছিল এই সংস্থার বিরুদ্ধে। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে এ রাজ্যে কলকাতার পুরসভার থিয়েটার রেপার্টরির কাজকর্মও শিকেয় ওঠার আশঙ্কা তৈরি হল। পুরসভা এই রেপার্টরির ভার নাট্যস্বজনকে দিয়েছিল। রেপার্টরির পক্ষ থেকে ‘চাঁদ বণিকের পালা’ মঞ্চস্থ করার কথা ছিল। সে সব কী হবে তা নিয়ে এখন ঘোর সংশয় উপস্থিত হয়েছে। এ বাদে ব্রাত্যর লেখা যে সব নাটক দেবেশের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হচ্ছিল এবং হওয়ার কথা ছিল, ব্রাত্যর লেখা যে সব নাটকে অর্পিতা অভিনয় করছিলেন সেগুলোর কী হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে নাট্য মহলে। সামনেই মুক্তি পাওয়ার কথা দেবেশ-পরিচালিত ছবি। তাতে প্রধান ভূমিকায় রয়েছেন ব্রাত্যই।