সময়টা গ্রীষ্মকাল। সরকারি অফিসার থেকে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ভিড়ে সরগরম শিলিগুড়ি লাগোয়া ফুলবাড়ি সীমান্ত। সন্ধ্যের আগেই কাঁটাতার পেরিয়ে ফুলবাড়ি স্থলবন্দর দফতরে পৌঁছলেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে আসা প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলাপচারিতার পরে, চা চক্রের সময় প্রতিনিধি দলের এক সদস্যের ‘ভিজিটিং কার্ড’ হাতে পেয়ে চমকে উঠেছিলেন শুল্ক দফতরের এক কর্তা। কার্ডে থাকা একাধিক মোবাইল নম্বরের মধ্যে দু’টি ভারতের সিমের নম্বর। বাংলাদেশি নাগরিকের কাছে কী ভাবে ভারতীয় সিম পৌঁছল সৌজন্যের খাতিরেই জানতে চাননি ওই কর্তা।
বছরখানেক আগের এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকের ওই ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়। যদিও, বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডের পরে এই ঘটনাই নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে জেলা পুলিশ এবং বিএসএফের আধিকারিকদের। টেলিকম রেগুলেটারি অথরিটি অব ইন্ডিয়া তথা ট্রাই এবং বিদেশ মন্ত্রকের নিয়ম অনুযায়ী কোন বিদেশি নাগরিক ভারতের সিম পেতে পারেন। তবে তা শর্তস্বাপেক্ষ এবং পর্যটক এথবা আপদকালীন প্রয়োজনে এ দেশে আসা নাগরিকদেরই এমন সিম মঞ্জুর করা হয়। তাও শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সে ক্ষেত্রে তার নাগরিকেত্বের প্রমাণপত্র, ভিসা, পাসপোর্টের প্রতিলিপি সহ একাধিক সংশাপত্র জমা দিতে হয়। সেই সিমের নম্বরগুলিও পৃথকভাবে ট্রাই এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে নথিবদ্ধ থাকে। তবে সীমান্তবর্তী এলাকায় এই ব্যবস্থার সামান্তরাল ভাবে চলা অবৈধ সিম চক্রের। মাত্র ৫০০ টাকা খরচ করলেই, ভুয়ো নথিতে ‘ঝক্কি’ এবং নজরদারি এড়িয়ে সিম মিলে যায় বলে অভিযোগ। বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলের সেই সদস্যের কাছেও সে ভাবেই একাধিক ভারতীয় সিম পৌঁছে গিয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
জলপাইগুড়ি জেলার সীমান্তবর্তী বেরুবাড়ি, রাজগঞ্জ এবং ফুলবাড়ি তিন এলাকায় কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন গ্রাম রয়েছে। ভারতের মোবাইল সিম সংস্থাগুলির বেস ট্রান্সমিশান সেন্টার (বিটিএস) তথা টাওয়ার শক্তিশালী হওয়ায় পঞ্চগড় জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে ভারতের নেটওয়ার্ক দিব্যি মিলে যায় বলে অভিযোগ। যেহেতু ভারতীয় বিটিএস বা মোবাইল টাওয়ার থেকে ছড়িয়ে পড়া নেটওয়ার্ক তরঙ্গেই কথা বলা হচ্ছে, তাই বাংলাদেশে বসে এ ধরনের সিমে কথা বললেও, লোকাল কল হিসেবে চিহ্নিত হয়। তারফলে এই কলগুলি নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলি খুব একটা মাথা ঘামায় না। সে সুযোগেই অবাধে নানা রকম তথ্য আদান প্রদান করা সম্ভব হয় বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলি মনে করছে। জেলা পুলিশের একটি সূত্রের খবর, গত এক বছরে অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে ধৃত অন্তত ৬০ জনের কাছে ভারতীয় সিম পাওয়া গিয়েছে। তাঁরা সকলেই বাংলাদেশি নাগরিক।
বিএসএফের উত্তরবঙ্গের আইজি এসকে সুদের কথায়, “বিভিন্ন ঘটনায় উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশি ভা ভারতীয় সিম বাজেয়াপ্ত করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কোন পথে সেই সিম যাচ্ছে, তা তদন্ত করে দেখার দায়িত্ব জেলা পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থাদের।”
যত সহজে বাংলাদেশে থেকে মোবাইলে ভারতের সংস্থার নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়, তার থেকেও সহজে সিম মেলে বলে অভিযোগ। বেরুবাড়ি, চাউপলাহাটি, গড়ালবাড়ি এবং ফুলবাড়ি এলাকায় মোবাইল সিমের একটি চক্র গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। নুন্যতম ৫০০ টাকার বিনিয়মে জাল নথি তৈরি করে বাংলাদেশে সিম পৌঁছে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। প্রাথমিক তদন্তের পরে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ভারতের কোনও নাগরিকের জমা দেওয়া সংশাপত্রের প্রতিলিপি সংগ্রহ করে এবং জমা দেওয়া ছবি ‘স্ক্যান’ করে একটির বদলে দু’টি সিম বের করা হয়। একটি সিম গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিয়ে অন্যটি চোরাপথে বিক্রি করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। সীমান্তে সক্রিয় চোরাচালানকারী চক্র সহ জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যদের কাছে এ ধরণের সিমের বিপুল চাহিদা রয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সূত্রের খবর।
বর্ধমান কাণ্ডের পরে এই প্রবণতা রুখতে এবার সিম চক্রের চাইদের নাগাল পেতে চাইছে পুলিশও।