সোমবার মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে অশোক রুইদাস।
হাসপাতাল চত্বরে দু’টি মৃত্যু। প্রশ্ন একাধিক।
সোমবার সকালে সংবাদমাধ্যমের একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়, এ দিন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের চত্বরে ২৬ বছরের যুবকের দেহ ঘিরে হাহাকার করছেন এক পিতা। বলে চলেছেন, ‘‘আমার বাবারে কোথায় নিয়ে এলাম! আমার ছেলের করোনা হয়নি, টাইফয়েড হয়েছিল। সব কাগজ আমার কাছে রয়েছে।’’
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে মৃত যুবক অশোক রুইদাসের (২৬) বাবা জগদীশ যখন স্বগতোক্তি করে চলেছেন, পাশে দাঁড়িয়ে মৃতের মামাতো ভাই। তিনি জানান, সপ্তাহখানেক ধরে দক্ষিণ বারাসতের একটি নার্সিংহোমে ছিলেন তাঁর ভাই। রক্তপরীক্ষায় টাইফয়েড ধরা পড়েছিল। সোমবার রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে বাবা জগদীশ এবং মা মালতী তাঁকে নিয়ে এসএসকেএম হাসপাতালে যান। এসএসকেএমের ফিভার ক্লিনিক শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে খোলা হয়েছে। অশোকের উপসর্গ শুনে তাঁকে জরুরি বিভাগ থেকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের ফিভার ক্লিনিকে পাঠানো হয়। পরিজনের বক্তব্য, অশোকের টাইফয়েড হলেও জ্বর-শ্বাসকষ্টের উপসর্গ শুনে করোনা সন্দেহে ১০২ অ্যাম্বুল্যান্সে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়। পরিজনের বক্তব্য, মেডিক্যালে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুল্যান্সে অশোকের প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছে জরুরি বিভাগের বাইরে একটি স্ট্রেচারে তাঁকে শোওয়ানো হয়। তাঁকে পরীক্ষা করে দ্রুত ভর্তির পরামর্শ দেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা। কিন্তু কাগজপত্র তৈরির মধ্যেই অশোকের মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন: ‘করোনা সন্দেহভাজনদের ভর্তির কোনও ব্যবস্থা নেই, আমরা গরিব মানুষ কোথায় যাব?’
এর পর মৃতদেহ সরানোর জন্য হাসপাতালের পিপিই পরিহিত এক কর্মী এগিয়ে এলে ছুটে আসেন বাবা। জানান, করোনা না-হলেও ছেলে চিকিৎসা পেল না। এ বার তো দেহ ধাপায় নিয়ে চলে যাবে! ছেলের দেহ নিয়ে চলে যান তিনি। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে খবর, সেখানে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা প্রাথমিক ভাবে বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু পিতার শোকের সামনে তাঁরা পারেননি।
জয়নগরের এই যুবকের মৃত্যু প্রসঙ্গে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উপাধ্যক্ষ তথা সুপার ইন্দ্রনীল বিশ্বাস বলেন, ‘‘কোভিড হাসপাতাল হিসাবে এখানে শুধু কোভিড পজ়িটিভদেরই পাঠানোর কথা। সব রোগীকে নিলে দেখা যাবে, কোভিড রোগীরাই শয্যা পাচ্ছেন না। ওই যুবক এখানে মৃতপ্রায় অবস্থায় আসেন। কিছু করার ছিল না।’’
আরও পড়ুন: ‘সংখ্যাবৃদ্ধি দেখে বেশি আতঙ্কের কিছু নেই’
অল্প দূরত্বের মধ্যে রোগীর শারীরিক অবস্থার এতটা অবনতি হল কী করে? এসএসকেএমের উপাধ্যক্ষ তথা সুপার রঘুনাথ মিশ্র বলেন, ‘‘জ্বর ও শ্বাসকষ্টের উপসর্গ থাকায় ‘সারি’ রোগী হিসাবে ওই যুবককে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়। তবে রোগীকে স্থিতিশীল করে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা নব্বইয়ের উপরে ওঠার পরই অ্যাম্বুল্যান্সে পাঠানো হয়।’’ মেডিক্যালের উপাধ্যক্ষ তো বলছেন, শুধু কোভিড পজ়িটিভদেরই পাঠানোর কথা! এসএসকেএমের উপাধ্যক্ষের জবাব, ‘‘জ্বর-শ্বাসকষ্ট থাকলে আমরা তো মেডিক্যালেই পাঠাই।’’
কিন্তু শ্বাসকষ্ট থাকা সত্ত্বেও অ্যাম্বুল্যান্সে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়নি কেন? কর্তৃপক্ষ বলছেন, নিয়ম মেনেই এসএসকেএম বা শম্ভুনাথ পণ্ডিত থেকে মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের সঙ্কটজনক রোগীর কথা ভেবে কি এসএসকেএমে আইসোলেশন ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা যায় না? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে বলা হয়, এ ধরনের হাসপাতাল থেকে সঙ্কটজনক রোগীকে কখনওই ফেরানোর কথা নয়। এ ধরনের ঘটনাগুলি নিয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা তদন্ত করবেন।
প্রশ্ন উঠেছে দক্ষিণ বারাসতের নার্সিংহোমের ভূমিকা নিয়ে। রোগীকে সপ্তাহখানেক ফেলে রেখে তার পর কেন পাঠানো হল কলকাতায়? যুবকের চিকিৎসা যিনি করছিলেন, সেই স্মরজিৎ নস্করের দাবি, ‘‘গত ৮ জুলাই ওই যুবককে ভর্তি করানো হয়। রক্ত পরীক্ষায় টাইফয়েড ধরা পড়ে। পরিবার জানিয়েছিল, রোগীর আগেই করোনা পরীক্ষা হয়েছে।’’ চিকিৎসকের দাবি, তিন দিন পর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। পরিবার শোনেনি। এ দিন সকালে তাঁরা রোগীকে বারুইপুর মহকুমা হাসপাতালে ‘রেফার’ করেছিলেন। তবে পরিবার কলকাতায় নিয়ে যান। আগেই যুবককে কলকাতায় আনা হলে বাঁচানো যেত কি না, প্রশ্ন উঠেছে।
কোভিড মেডিক্যাল কলেজে এ দিন আর একটি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে। ঠনঠনিয়ার বাসিন্দা লক্ষ্মী সাউ (৬৫) গত কয়েক দিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। ক্লান্তিভাব, বমি, গায়ে ব্যথা এবং অল্প শ্বাসকষ্টও ছিল। বৃদ্ধার মেয়ে শুক্লার দাবি, এ দিন মায়ের শ্বাসকষ্ট প্রবল হওয়ার পর হাজার চেষ্টা করেও অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করতে পারেননি তিনি। উপসর্গ শুনেই সকলে পিছিয়ে যান। শেষমেশ ভ্যানরিকশা জোগাড় করে দুপুর ২টোর কিছু পরে মেডিক্যাল পৌঁছন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হাসপাতালের গেট পেরনোর সময়ও প্রাণ ছিল বৃদ্ধার। কিন্তু জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আসার আগে ভ্যানরিকশ’তেই তাঁর মৃত্যু হয়।