আমরা আলু সারা বছর ধরে খাই। কিন্তু আলু চাষের একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। তাই সারা বছরের আলু পেতে সংরক্ষণ করাটা জরুরি। সমস্যাটা এখানেই। এই রাজ্যে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট আলু উৎপাদিত হলেও হিমঘর কম বলে উৎপাদনের একটা বড় অংশ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। ওই আলু চাষিরা বাড়িতে ফেলে রাখেন কিংবা জলের দরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। এই বাড়িতে রেখে দেওয়াটা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে করলে কিন্তু সহজে আলু পচে না। নিজেরাই বাড়িতে আলু সংরক্ষণ করতে পারলে জলের দরে বেচার দরকারও পড়ে না।
প্রায় পাঁচ মাস পর্যন্ত কোনও রকম ক্ষতি ছাড়া বসতবাড়িতে স্বাভাবিত তাপমাত্রায় আলু সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এর জন্য চাষের আগে-পরে কিছু পন্থা নিতে হয়—
চাষের সময়
ফসলে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে কম পটাশ বা বেশি নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করা চলবে না।
আলু তোলার ৭-১০ দিন আগে সেচ বন্ধ করে দিতে হবে।
তোলার সময়
ফসল তোলার ১০-১৫ দিন আগে ডাঁটা কেটে ফেলতে হবে।
জমিতে জো থাকাকালীন সকালের দিকে শীত-শীত ভাব থাকতেই আলু তোলা ভাল।
তোলার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন আলু কেটে না যায়, খোসা ছিঁড়ে না যায় এবং দূর বা উঁচু থেকে আলু ছুড়ে-ছুড়ে না রাখা হয়।
বাঁশের টুকরিতে আলু না রেখে অ্যালুমিনিয়াম বা প্লাস্টিকের গামলায় রাখলে ভাল। বাঁশের টুকরি বা খুরিতে রাখলে চট বিছিয়ে নিতে হবে।
তোলার পরে
বেশিক্ষণ রোদে রাখা চলবে না। মাঠেই যদি রাখতে হয়, সেক্ষেত্রে পলিথিন বা ত্রিপল দিয়ে না ঢেকে শুকনো খড় বা কচুরিপানা বা পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে—যাতে বায়ু চলাচল স্বাভাবিক থাকে।
রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে অস্থায়ী শেডও বানানো যেতে পারে।
সদ্য তোলা আলু ক্ষেত থেকে আনার পর ছায়ায় ছড়িয়ে খোলা বাতাসে রাখতে পারলে সবচেয়ে ভাল। আসলে এই অবস্থায় ১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৮৫ ভাগ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় ৭-১০ দিন থাকলে আলুর ক্ষত সেরে ওঠে ও চামড়া শক্ত হয়।
খারাপ, কাটা, রোগগ্রস্ত ও ভিজে আলু বাতিল করা জরুরি। প্রয়োজনে আকার অনুযায়ী ভাগ করে নিন। রোগপোকা আক্রান্ত গাছের আলু বাতিল করতে হবে।
পরিবহণ
আলু পরিবহণেও সতর্কতা দরকার। আলুর বস্তা সাবধানে নাড়াচড়া করতে হবে, উপর থেকে বা মাথা থেকে আছড়ে নীচে ফেলা ঠিক নয়। বস্তার উপর বসা খারাপ অভ্যাস।
গুদামঘরে মজুত
বসতবাড়িতে কম খরচে আলু রাখতে চাইলে এর জন্য আলাদা করে গুদামঘর বানাতে হবে। ওই গুদামঘর তৈরির সময়ও কয়েকটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে।
বায়ু চলাচল: আলু যেহেতু জীবন্ত, ভূনিম্নস্থ রূপান্তরিত কাণ্ড, সেই জন্য সংরক্ষণের সময়ও শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ চলতে থাকে। তাই আলু রাখার গুদামঘরে ঠিকঠাক বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখা জরুরি, যাতে অক্সিজেনের অভাব না হয়। ছোট জায়গায় বেশি পরিমাণে আলু রাখলে অক্সিজেনের অভাবে আলুতে ব্ল্যাক হার্ট রোগ হয়।
আলো থেকে দূরে: আলুতে সূর্যের আলো পড়লে সবুজ রঙের হয়ে যায় ও চামড়ায় বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হয়। তাই গুদামঘরে সূর্যালোক যেন সরাসরি কখনও না আসে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ঠান্ডা জায়গা: গুদামঘর অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা হলে ভাল। তাই গাছের ছায়ায় বা পুকুর পাড়ে গুদামঘরের অবস্থান হলে খুব ভাল হয়। ঘরের চাল খড় বা শনের হলে বেশি ঠান্ডা থাকে।
পরপর মাচা: নতুন ঘর তৈরির সময় মাটি থেকে এক ফুট উপরে একটা মাচা বানাতে হবে। তার উপরে দ্বিতীয় মাচার দূরত্ব হবে আড়াই থেকে তিন ফুট। একই দূরত্বে তৃতীয় ও চতুর্থ মাচা বানান। সর্বোচ্চ মাচা ছাদ থেকে ৩-৫ ফুট নীচে থাকলে ভাল হয়। নইলে ছাদের তাপে আলুর ক্ষতি হতে পারে।
মাচা তৈরির পর তাতে ১০-১২ ইঞ্চি পুরু করে আলু রাখতে হবে। এই ভাবে চারটি তাকে প্রায় আট হাজার কেজি আলু মজুত করা সম্ভব।
খেয়াল রাখবেন
কীটনাশক নয়: সংরক্ষিত আলু যেহেতু খাবার হিসাবে ব্যবহৃত হয়, সেহেতু সংরক্ষণের সময় কোনও কীটনাশকের ব্যবহার বা আগে কোনও কীটনাশকে চুবিয়ে নেওয়া ক্ষতিকর। তবে মাচায় শুকনো নিমপাতা বিছিয়ে দিতে পারেন। এতে পোকার উপদ্রব কমে।
খোলা জানলা: গুদামঘরের দরজা, জানলা চওড়া ও বড় হলে ভাল হয়। জানলা খোলা থাকলে বায়ু চলাচল স্বাভাবিক থাকে। সংরক্ষিত আলুতে যাতে রোদ না পড়ে, তার জন্য দিনের বেলা জানলার ঝাপ অর্ধেক খোলা থাকবে, রাতে পুরো খোলা।
আর্দ্রতা বজায়: গুদামঘরের কাছে জলাশয় না থাকলে বড় হাঁড়িতে করে জল রাখা যেতে পারে জানলার কাছাকাছি। তাতে উচ্চ আর্দ্রতা বজায় থাকে।
গাছের ছায়া: বড় গাছের ছায়া না পেলে গুদামঘরের ছাদের উপর তুলে দেওয়া যেতে পারে লাউ, কুমড়ো, সিম জাতীয় গাছ।
তারজালি-মশারি: যে সব এলাকায় টিউবার মথ বা সুতলি পোকার উপদ্রব, সেখানে গুদামঘরের জানলায় অবশ্যই চিকন তারজালি দিতে হবে। তাছাড়া আলুর স্তূপ মশারি দিয়ে ঢেকে রাখা যেতে পারে।
নিয়মিত নজরদারি: আলু রাখার পর থেকে প্রতি ২০-২৫ দিন অন্তর আলুর গাদা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। পচা বা রোগগ্রস্ত আলু দেখামাত্র সরিয়ে ফেলতে হবে।
কম খরচের লাভজনক এই প্রযুক্তি ব্যবহারে হিমঘরে স্থানাভাবের সমস্যা কিছুটা হলেও মিটবে।
লেখক বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।