নেতাদের মুখেও একই বন্ধনীতে শোনা যাচ্ছে যোগী আদিত্যনাথ এবং নরেন্দ্র মোদীর নাম। —ফাইল ছবি।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক সেরে দিল্লি থেকে সদ্য কলকাতায় ফিরেছেন বঙ্গ বিজেপির এক প্রথম সারির নেতা। বিকেলের দিকে দলের রাজ্য দফতরের উপর থেকে নীচে নেমেছেন একগুচ্ছ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকে দলের প্রতিক্রিয়া জানাতে। ওয়াকফ বিল প্রসঙ্গে কথা উঠতেই বললেন, ‘‘মোদী-যোগীর ভারতে এই রকম বৈষম্যমূলক আইন থাকবে না।’’
মোদী-যোগী। নরেন্দ্র মোদী-যোগী আদিত্যনাথ। বিজেপির সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা অনেক দিন ধরেই একযোগে উচ্চারণ করছিলেন এই দুই নাম। এ বার নেতাদের মুখেও মোদী আর যোগীর নাম একই বন্ধনীতে শোনা যাচ্ছে। নির্মল আবেগ? না কি সচেতন মন্তব্য?
ঘটনাচক্রে, এমনই ঘটেছিল তৃণমূলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামের পাশেই বার বার উচ্চারিত হচ্ছিল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। মমতা ‘নেত্রী’, অভিষেক ‘সেনাপতি’— এমন বাক্যবন্ধও তৈরি হয়েছিল। তা যে তৃণমূলে মমতার উত্তরসূরি চেনানোর সচেতন প্রয়াস ছিল, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিশেষ সংশয় ছিল না (যদিও তৃণমূলের অন্দরের সেই সমীকরণ এখন আবার খানিকটা বদলে গিয়েছে)। বিজেপিতেও কি এ বার তেমনই কোনও ‘পদ্ধতি’ তৈরি হচ্ছে? প্রকাশ্য মন্তব্যে অবশ্য রাজি নন রাজ্যের বিজেপি নেতাদের কেউ।
প্রথমে দেশের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গোটা ভারতের নজর কাড়া। তার পরে বুলডোজ়ার-নীতি, এনকাউন্টার-নীতিতে ভর করে আরও বেশি চর্চায় আসা। কলকাতা হাই কোর্টের এক বিচারপতিও এক বার শুনানির সময়ে বলেছিলেন, ‘‘প্রয়োজনে উত্তরপ্রদেশ থেকে বুলডোজ়ার নিয়ে আসুন!’’ উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে পিঠোপিঠি দু’বার সরকার গঠনের পর বিজেপির অন্দরে যোগীর উচ্চতা আরও বেড়েছে। সেই যাত্রাপথে অবশ্য ঘরোয়া প্রতিপক্ষের তরফে যোগীর বিরোধিতাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। কিন্তু বিজেপি-মানসে ‘যোগী আদিত্যনাথ’ নাম সুপ্রতিষ্ঠিত। ফলে দেশ জুড়ে বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের মুখে মোদী-অমিত শাহদের নামের পাশে যোগীর নামও উঠে আসতে শুরু করেছিল। সম্প্রতি নেতাদের বয়ানেও শোনা যাচ্ছে যোগীনাম। কেন? কেন্দ্রের শাসকদলের প্রথম সারির নেতাদের মুখে কেন মোদী-যোগী পাশাপাশি?
প্রসঙ্গটি এতই ‘স্পর্শকাতর’, যে বঙ্গ বিজেপির শীর্ষনেতাদের কেউই মন্তব্যে রাজি নন। মোদীর উত্তরসূরি হিসেবে যাঁদের নাম বিজেপিতে চর্চিত, সেই তালিকায় শাহের উজ্জ্বল উপস্থিতি। আর শাহ-যোগী সমীকরণ বিজেপিতে সকলেই জানেন। ফলে যোগীর নাম মোদীর পাশাপাশি কেন আসছে, সে প্রসঙ্গে মুখ খোলার ঝুঁকি কেউ নিতে চান না। তবে নাম না প্রকাশ করার শর্তে এ রাজ্যের এক জনপ্রতিনিধির ব্যাখ্যা, ‘‘এর মধ্যে কোনও আভাস খোঁজার দরকার নেই। মোদীজির নাম অনেক ক্ষেত্রে একক ভাবেই উচ্চারিত হয়। আবার অনেক সময় তাঁর নামের সঙ্গে অমিতজির নামও উচ্চারিত হয়। কখনও মোহন ভাগবতজির নামও উচ্চারিত হয়। তেমনই যোগীজির নামটাও অনেকে অনেক সময়ে মোদীজির নামের পাশাপাশি বলেন।’’ সেই জনপ্রতিনিধির আরও ব্যাখ্যা, ‘‘বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনার প্রেক্ষিতে যোগীজির নাম আসতে পারে। যোগীজিকে অনেকেই একটা শক্তিশালী মুখ হিসেবে দেখেন।’’ পাশাপাশিই তিনি মানছেন যে, যোগী বিজেপির একেবারে সামনের সারির ‘মুখ’ হিসেবেই উঠে এসেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এটা নিয়ে সন্দেহ থাকা উচিত বলে আমার মনে হয় না। যে ভাবে অমিতজিকেও একেবারে সামনের সারিতেই সকলেই রাখেন, সে ভাবেই যোগীজিও দলের মধ্যে জনপ্রিয়।’’
তৃণমূলের অবশ্য বিষয়টা এমন ছিল না। মমতার ‘উত্তরসূরি’ যে অভিষেক, তা নিয়ে রাখঢাক করে কথা বলার কোনও প্রয়োজন পড়ত না। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রচারের যে ‘থিম সং’ বাঁধা হয়েছিল, তা শুধু মমতাকেন্দ্রিক ছিল। ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’। কিন্তু পাশাপাশিই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ‘আকাশে বাতাসে পজিটিভ এনার্জি / নামটা মনে আছে না? অভিষেক ব্যানার্জি’ গানও। ভোটযুদ্ধ শেষ হতেই অভিষেকের ‘কঠোর পরিশ্রম’কে কৃতিত্ব দেওয়া শুরু হয়। ‘সবুজ সেনার সেনাপতি’ গান বাজতে শুরু করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে।
এখন অবশ্য তৃণমূলের অন্দরের পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। দলের ভিতরে-বাইরে একাধিক বার মমতা বার্তা দিয়েছেন যে, দল তিনিই চালাবেন। পুলিশ-প্রশাসনেও তিনিই শেষ কথা বলবেন। হাওয়ার অভিমুখ আঁচ করে একদা অভিষেক-ঘনিষ্ঠদের অনেকে ‘সেনাপতি’র বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। অভিষেকের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচিতদের কেউ সাসপেন্ড হয়েছেন, কেউ পদ হারিয়েছেন, কেউ শো কজ়ের মুখে পড়েছেন। দলের পরবর্তী প্রজন্মের ‘মুখ’ যে অভিষেকই, সে কথা তৃণমূলে একটা সময় স্পষ্ট ভাবেই ঘোষিত ছিল। কিন্তু ইদানীং সে সব তত্ত্ব কেউ বলছেন না। কিন্তু সেই পরিসরে মোদী-যোগী শব্দবন্ধ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও বাংলার ‘সাবধানি’ বিজেপি নেতারা মোদী-যোগীর নাম আবেগের বশে বা সচেতন ভাবে পাশাপাশি উচ্চারণ করলেও প্রকাশ্যে তা নিয়ে মন্তব্য করছেন না। কে জানে হাওয়া কবে ঘুরে যায়! রাজনীতি তো।