তাঁর সাধারণ সম্পাদক হওয়ার নেপথ্যে বড় ভূমিকা ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বঙ্গ ব্রিগেডের। তারই প্রতিদানে বাংলায় দলের প্রয়োজনে এ বার পাশে দাঁড়াতে আসছেন সিপিএমের নতুন কাণ্ডারী সীতারাম ইয়েচুরি। জেলায় জেলায় আজ, শনিবার পুরভোটের পরে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল কী ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে, সেই প্রক্রিয়ায় আলিমুদ্দিনের সঙ্গে সরাসরিই শরিক হবেন দলের সাধারণ সম্পাদক।
সব ঠিক থাকলে ৯১টি পুরসভার ভোটের পর দিন, রবিবারই কলকাতায় আসছেন ইয়েচুরি। দলের সবর্ভারতীয় দায়িত্ব নেওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গই হতে চলেছে তাঁর প্রথম রাজ্য সফর। পুরভোটের আগে সর্বশেষ পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে শুক্রবার আলিমুদ্দিনে আলোচনায় বসেছিলেন দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যেরা। দিল্লিতে সংসদের অধিবেশনের কাজে ব্যস্ততার মধ্যেও দলের রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে কথা হয়েছে ইয়েচুরির। বাংলার নেতারা চাইছেন, পুরভোটের দিনটা কেটে যাওয়ার পরে ফলাফল ঘোষণার আগেই নতুন সাধারণ সম্পাদক এক বার কলকাতায় এলে ভাল। পুরভোটের ফলাফল যা-ই হোক, আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে দলকে রাস্তায় রাখতে চান বুদ্ধবাবু, সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুরা। সেই মর্মেই ইয়েচুরির সঙ্গে শলা-পরামর্শ চালাচ্ছেন তাঁরা। আলিমুদ্দিনের ডাক পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক। কোনও কারণে রবিবার আসতে না পারলে তার এক-দু’দিনের মধ্যেই তিনি হাজির হবেন, তা-ও ঠিক হয়েছে।
প্রয়োজনের মুহূর্তে আলিমুদ্দিনের ডাক এবং ইয়েচুরির সাড়া দেওয়া— দু’তরফের মনোভাবেই স্পষ্ট, প্রকাশ কারাট জমানা দ্রুত অতীত হতে শুরু করেছে! বস্তুত, ব্যক্তিগত ভাবে ইয়েচুরি এক সময় চেয়েছিলেন, আজ পুরভোটে বাংলায় দলের কর্মীরা যখন শাসক দলের মোকাবিলা করবেন, তখন তিনিও দিল্লিতে বসে থাকবেন না। রাজ্য নেতাদের সঙ্গেই পরিস্থিতির উপরে নজর রাখবেন। কিন্তু পুরভোটের সময়ে বাইরে থেকে এসে তিনি বিধি ভাঙছেন, এমন কোনও বিতর্ক তৈরি করার সুযোগ তৃণমূলকে দিতে চান না সিপিএম নেতৃত্ব। তাই ভোট মিটতেই বাংলায় আগমনের সিদ্ধান্ত। পুরভোটে শাসক দলের কাণ্ডকারখানা দেখে সিপিএম শেষ পর্যন্ত বাংলায় বন্ধই ডাকুক বা যা-ই করুক, তা করা হবে ইয়েচুরির সঙ্গে পরামর্শ সাপেক্ষেই।
পুরভোটের সময় বাংলায় লড়াইয়ের দিকেই যে তাঁর মন রয়েছে, তা-ও বুঝিয়ে দিতে কসুর করছেন না ইয়েচুরি। তাঁর কথায়, ‘‘দলের কর্মীদের একটা কথাই বলব। পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টদের আন্দোলনের ঐতিহ্য ঐতিহাসিক। বহু সময়ে বহু লড়াই তাঁরা করেছেন। সেই পরম্পরা বজায় রেখেই তাঁরা এগিয়ে চলবেন। জমি ছাড়ব না আমরা!’’ শাসক তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’ প্রতিরোধের ডাক দেওয়া হলেও কলকাতায় পুরভোটের দিন বাম কর্মী-সমর্থকদের সে ভাবে রাস্তায় নেমে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। আগামী দিনের জন্য বার্তা দিয়ে ইয়েচুরি তাই বলছেন, ‘‘বাংলায় কংগ্রেসি আমলেও বহু সন্ত্রাসের মোকাবিলা করে আমাদের এগোতে হয়েছে। আমাদের কর্মীরা সেই ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। তাঁরা ভীত নন, বিভ্রান্তও নন। সামনে যে বাধাই আসুক, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা মোকাবিলা করতে তৈরি।’’ বামেদের নিয়ে আতঙ্কে আছে বলেই মমতার দলকে জবরদস্তি এবং সন্ত্রাসের আশ্রয় নিতে হচ্ছে, সেই যুক্তিও দিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক।
আলিমুদ্দিনের তরফে দলের শীর্ষ নেতাকে জানানো হয়েছে, কলকাতার চেয়ে জেলাগুলিতে পুরভোটে বেশি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হবে বলেই আশা করা যায়। বিশেষত, উত্তরবঙ্গে তৃণমূল সহজে ছাড় পাবে না। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, ‘‘১৮ এপ্রিলের ভোট থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মীদের মনোভাব এখন একটু বেশি লড়াকু। মানুষও বুঝতে পারছেন। শিলিগুড়ি, সোনামুখী, তমলুক, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় গোলমাল পাকানোর ছক ধরে ফেলা হয়েছে। আশা করছি, এ বার আর তৃণমূল যা খুশি করে বেরিয়ে যেতে পারবে না!’’ পরিস্থিতি বুঝে তাঁরা যাতে প্রতিরোধে নেমে প়ড়েন, জেলা নেতৃত্বকেও সেই সঙ্কেত দিয়েছে আলিমুদ্দিন। এক জেলা সম্পাদকের কথায়, ‘‘বাইরে থেকে লোক ঢুকিয়ে আমরা পাল্টা গণ্ডগোল করতে চাই না। কিন্তু গণ্ডগোল করতে এলে বাধা দিতে হবে।’’
পার্টি কংগ্রেস থেকে ফিরেই সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাট সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে ‘ভাইজ্যাগ লাইন’ প্রবন্ধ লিখে বুঝিয়ে দিয়েছেন, নতুন সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন মানেই দলের ‘লাইন’ বদলে কংগ্রেস-সহ অন্য কিছু দলের সম্পর্কে নরম মনোভাব নেওয়া হবে, এমন ভাবার কারণ নেই। বৃন্দার এই বক্তব্য যে ইয়েচুরির জন্য লক্ষ্মণরেখা বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা, চর্চা হচ্ছে সিপিএম মহলে। ইয়েচুরি অবশ্য এ সবে বাড়তি গুরুত্ব দিতে নারাজ। তিনি জানেন, বাংলায় গড় বাঁচানোই প্রথম কর্তব্য।