নবান্ন। —ফাইল চিত্র।
সংসদে পাশ হয়েছে মহিলা সংরক্ষণ বিল। যার ফলে লোকসভা ভোটেও এ বারে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ আসন সংরক্ষিত করা হবে। যা অনেক আগেই পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত পর্যায়ে চালু হয়ে গিয়েছে। অথচ অভিযোগ, এ বারের মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানদের সঙ্গে তাঁদের স্বামীদেরও ডাকা হল সরকারি প্রশিক্ষণে। তাও পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়, যে জেলার পাঁশকুড়া কেন্দ্রের প্রাক্তন সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায় প্রায় তিন দশক আগে সংসদে প্রথম মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষণের দাবি তুলেছিলেন।
প্রশাসন স্পষ্টই বলছে, মহিলা প্রধানকে সুষ্ঠু ভাবে কাজ করতে হলে স্বামীর সহযোগিতা জরুরি। তাই এই যৌথ প্রশিক্ষণ। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে যে দাবি মুখ্যমন্ত্রী বরাবর করে আসছেন, তা আর কতটা যৌক্তিক রইল?
মঙ্গলবার পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসকের দফতর থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হয়, রাজ্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের নির্দেশ মেনে জেলার সব মহিলা পঞ্চায়েত প্রধান, তাঁদের স্বামী এবং সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতের এক কর্মীকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ৫ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি নিমতৌড়িতে হবে দু’দিনের বিশেষ আবাসিক প্রশিক্ষণ শিবির।
মহিলা জনপ্রতিনিধিরা, বিশেষ করে পঞ্চায়েতস্তরে যাঁরা জেতেন, তাঁদের প্রশাসনিক কাজ পরিবারের পুরুষ অভিভাবকেরা সামলান— এই ছবি গোটা দেশের। সম্প্রতি ‘পঞ্চায়েত’ ওয়েব সিরিজ়েও মধ্যপ্রদেশের পটভূমিকায় দেখা গিয়েছে সেই দৃশ্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের তরফে কার্যত বিষয়টি মেনে নেওয়ার ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে।
অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) অনির্বাণ কোলে বলেন, ‘‘অনেক মহিলা প্রথম প্রধান হয়েছেন। পঞ্চায়েতের কাজ সুষ্ঠুভাবে চালাতে গেলে তাঁর স্বামীর সহযোগিতা থাকাটা জরুরি।’’ তিনি আরও জুড়লেন, ‘‘কেউ হয়তো আগে পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন। এ বার তাঁর স্ত্রী হয়তো প্রধান হয়েছেন। সে ক্ষেত্রে স্বামী তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে স্ত্রীকে পঞ্চায়েত পরিচালনায় সহযোগিতা করতে পারবেন। তবে এতে মহিলা প্রধানদের স্বামীদের সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না।’’
কিন্তু এই ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয় বলেই দাবি সংশ্লিষ্টমহলের। মহিলা প্রধানরা যে স্বামী ছাড়া অচল, কার্যত সেটাই মেনে নেওয়া হয়েছে বলে অভিমত পর্যবেক্ষক মহলের।
সমাজের মানসিকতা কেন বদলানো যাচ্ছে না, উঠেছে সেই প্রশ্নও। পাঁশকুড়ার গোবিন্দনগর পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্যা নিলুফা খাতুন বলছেন, ‘‘হেঁশেল সামলানো থেকে মহাকাশ অভিযান, সবেতেই মহিলারা দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। তার পরেও মহিলা প্রধানরা কি পঞ্চায়েত চালানোর ক্ষেত্রে এতটাই অযোগ্য যে পাশে তাদের স্বামীদের লাগবে?’’ পাঁশকুড়া পশ্চিমের তৃণমূল বিধায়ক ফিরোজা বিবির অবশ্য মত, ‘‘কেউ একা কাজ করতে পারেন না। পঞ্চায়েত চালাতে গেলে প্রধানদের সাহায্য নিতে হয়। মহিলা প্রধানের স্বামীকে প্রশিক্ষণ দিলে তিনিই স্ত্রীকে সাহায্য করতে পারবেন।’’
এই যুক্তিতে তো পুরুষ প্রধানদের সঙ্গে তাঁদের স্ত্রীদের প্রশিক্ষণও জরুরি। কিন্তু তা হচ্ছে কই? সরকারের সমালোচনা করে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সমাজ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘নবান্নে বাংলা চায় তার মেয়েকে। আর নবান্ন চায় প্রধানপতিকে।’ বিজেপির তমলুক সাংগঠনিক জেলার সহ-সভাপতি দেবব্রত পট্টনায়েকের মতে, ‘‘তৃণমূল সরকার মহিলা প্রধানদের স্বামীদের মাধ্যমে পঞ্চায়েতগুলিকে দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করতে চাইছে।’’ রাজ্যের পঞ্চায়েত প্রতিমন্ত্রী শিউলি সাহার পাল্টা দাবি, ‘‘মহিলা প্রধানের স্বামীদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি। কোনও জেলাকেই এই প্রশিক্ষণ দিতে বলা হয়নি। পূর্ব মেদিনীপুর কেন এই আয়োজন করল তা দফতর খতিয়ে দেখবে।’’ তবে দেবব্রত মনে করিয়েছেন, এই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে কেন্দ্রীয় নির্দেশের মেমো নম্বরের উল্লেখ নেই।