কলকাতা ময়দানে মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির পাদদেশে ধর্নামঞ্চ। ফাইল চিত্র।
নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সঙ্কল্প নিয়ে উচ্চ প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষার ফর্ম ভরেছিলেন, পরীক্ষা দিয়েছিলেন কমবেশি আট-ন’বছর আগে। পাশ করেছেন, ইন্টারভিউ দিয়েছেন, কিন্তু চাকরি হয়নি। কারণ, মেধা-তালিকাই যে বেরোয়নি এখনও!
এই ন’বছরে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে নদিয়ার শিমুরালির সৌমিত্রা সাধুখাঁয়ের জীবনে। বিয়ে হয়েছে, সন্তান হয়েছে। স্বামীর চাকরির সুবাদে চলে যেতে হয়েছে আন্দামানে। কিন্তু স্বাবলম্বনের স্বপ্ন ও জেদ হারিয়ে যেতে দেননি। ছুটিতে আন্দামান থেকে বঙ্গে ফিরে সৌমিত্রা তাই সোজা পৌঁছে গিয়েছেন কলকাতা ময়দানে মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির পাদদেশে ধর্নামঞ্চে, চাকরির লড়াইয়ে শামিল হতে।
স্বামী-পুত্রকে নিয়ে দূর আন্দামানে সংসার করতে করতেও সৌমিত্রা বার বার ভেবেছেন উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষিকার চাকরিটা পেয়ে গেলে ফিরে আসবেন বাংলায়। কিন্তু কোথায় চাকরি? এখনও তো মেধা-তালিকাই বেরোল না। ‘‘যে-ক’দিন এই রাজ্যে আছি, চাকরির দাবিতে রোজ আসব এই ধর্নামঞ্চে,’’ বললেন সৌমিত্রা।
আন্দামানের রাজধানী শহর পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ১২ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিলে পৌঁছনো যায় ডিগলি পোর্টে। সেখানেই স্বামী-পুত্রকে নিয়ে সংসার সৌমিত্রার। স্বামী উপকূলরক্ষী বাহিনীতে কর্মরত। ছ’বছরের ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন সেখানকারই এক স্কুলে। সৌমিত্রা বললেন, ‘‘কত কিছুই তো পাল্টে গেল জীবনে। ভেবেছিলাম, স্বাবলম্বী হব। উচ্চ প্রাথমিকের শিক্ষকের চাকরি পেতে পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করেছিলাম ২০১৪ সালে। তখন বিয়ে হয়নি। ২০১৫ সালে পরীক্ষা দিলাম। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলাম। কিন্তু চাকরি হল না। তার পরে বিয়ে হল। ছেলে হল। ২০১৯ সালে এখানকার পাট চুকিয়ে স্বামীর সঙ্গে তাঁর কর্মস্থল আন্দামানেচলে গেলাম।’’
সেখান থেকেই ২০২২ সালের অগস্টে শিক্ষকের চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন সৌমিত্রা। বললেন, “ভেবেছিলাম এ বার হয়তো শিকে ছিঁড়বে। কিন্তু কিছুই হল না। ইন্টারভিউ দিয়ে ফের আন্দামানে চলে গেলাম। এখন কয়েক দিনের জন্য ছুটিতে এসেছি। মেধা-তালিকা তো এখনও বেরোল না।’’
শুধু বাড়ি নয়, শ্বশুরবাড়িও ওই শিমুরালিতে। সৌমিত্রা বললেন, এখন ‘‘আন্দামানে থাকলেও মনটা সারা ক্ষণ পড়ে থাকে এখানেই। পড়াশোনা করেছিলাম নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য। শিক্ষকতার চাকরিটা পেলে চলে আসব বাংলায়। আমার স্বামীর তাতে কোনও আপত্তি নেই। তার পরে ও আন্দামান থেকে বদলির আবেদন করবে। কিন্তু কিছু তো হচ্ছেই না।’’
আন্দামানে থাকলেও নিয়োগের কী অবস্থা, সেখান থেকেই তার উপরে নজর রাখেন সৌমিত্রা। বললেন, ‘‘খবর তো এখন বিশ্বের যে-কোনও প্রান্তে বসেই দেখা ও পড়া যায়। তা ছাড়া উচ্চ প্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সঙ্গেও আমি যুক্ত। ওখানে বসে সব আপডেট পাই। মাতঙ্গিনীর মূর্তির পাদদেশে কী হচ্ছে, কলকাতার রাজপথে আমাদের চাকরিপ্রার্থীরা কবে চাকরির দাবিতে হামাগুড়ি দিয়ে ডোরিনা ক্রসিং পেরোল— সব খবর আমার কাছে পৌঁছে যায়। খুব ইচ্ছে করে, ওদের সঙ্গে যোগ দিই। এ বার তাই ছুটিতে রাজ্যে ফিরেই চলে এসেছি মঞ্চে।’’
পশ্চিমবঙ্গ আপার প্রাইমারি চাকরিপ্রার্থী মঞ্চের সহ-সভাপতি সুশান্ত ঘোষ বলেন, ‘‘শুধু আন্দামান নয়, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ছত্তীসগঢ়-সহ বেশ কিছু রাজ্যেই ছড়িয়ে রয়েছেন উচ্চ প্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থীরা। তাঁদের সকলেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। ন’বছরের প্রতীক্ষা কবে শেষ হবে, কে জানে!’’