ট্রেন ছাড়া গতি নেই বনগাঁ রুটের বেশিরভাগ মানুষের

ক্যান্সার-আক্রান্ত বৃদ্ধা মাকে নিয়ে আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলেন বিভূতিভূষণ হল্টের বাসিন্দা সোমা বাইন। চিকিৎসা তো দূরের কথা, হাবরায় ইটবৃষ্টির মধ্যে পড়ে কী ভাবে মাকে নিয়ে যে বেঁচে ফিরেছেন সে কথা বলতে গিয়ে বার বার শিউরে উঠছিলেন ওই মহিলা।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও সীমান্ত মৈত্র

কলকাতা ও বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৫ ০১:১৩
Share:

ট্রেন অবরোধ হলেই এ দৃশ্য দেখা যায় যশোর রোডে। —নিজস্ব চিত্র।

ক্যান্সার-আক্রান্ত বৃদ্ধা মাকে নিয়ে আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলেন বিভূতিভূষণ হল্টের বাসিন্দা সোমা বাইন। চিকিৎসা তো দূরের কথা, হাবরায় ইটবৃষ্টির মধ্যে পড়ে কী ভাবে মাকে নিয়ে যে বেঁচে ফিরেছেন সে কথা বলতে গিয়ে বার বার শিউরে উঠছিলেন ওই মহিলা। তাঁর কথায়, ‘‘ছ’মাস অন্তর চিকিৎসা না করালে খুব সমস্যা হয়। অবরোধ, গোলমালের পরেও যশোর রোড ধরে বাস ধরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বাসের মাথাতেও গিজগিজে ভিড়। উপরে হাইটেনশন লাইন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শেষমেশ বাড়ি ফিরে এসেছি।’’

Advertisement

সোমা বাইন না হয় বাড়িতে ফিরতে পেরেছেন, কিন্তু হাবরার বাসিন্দা ওই আরজিকর হাসপাতালেরই এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘অবরোধের কবলে পড়ে আগেই সিএল নষ্ট হয়েছে। সোমবার আমাকে হাসপাতালে যেতেই হতো। তাই হাবরায় অবরোধ দেখে যশোর রোড থেকে বাসে উঠি। কিন্তু সেই বিশাল ভিড়ে, যানজটে পড়ে কী ভাবে যে হাসপাতালে পৌঁছেছি, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।’’ বাসে বাদুরঝোলা, অটোয় মারপিট— সবই সহ্য করতে হয়েছে তাঁর মতো অনেককে।

হাবরা থেকে তা-ও না হয় কলকাতায় পৌঁছনো সম্ভব। কিন্তু ঠাকুরনগর, গোবরডাঙা থেকে তো কলকাতা যাওয়ার কোনও বাস রুটই নেই। একমাত্র ভরসা লোকাল ট্রেন। ফলে গৌতম পাল, আরতী সিকদারের মতো ওই সব এলাকার নিত্যযাত্রীদের অফিস-কাছারি যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না সোমবার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেন ছাড়ার প্রতীক্ষায় ছিলেন তাঁরা। আবার গোপালনগরের স্কুল শিক্ষক দীপেন বসুর মতো সারাক্ষণ আটকে ছিলেন ট্রেনেই।

Advertisement


মাতৃভূমি লোকালে গোলমালের আশঙ্কায় মছলন্দপুরে জমায়েত পুলিশ। মঙ্গলবার নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

আশিস রায়ের মতো কারও আবার অফিসে না গেলে কোনও উপায়ই ছিল না। ফলে বনগাঁ লোকাল ধরে ‌ঠাকুরনগরে আটকে পড়ার পরে আশিসবাবু ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে ট্রেন থেকে নেমে পড়েন। আশিসবাবুর কথায়, ‘‘ঠাকুরনগর থেকে একটি ইঞ্জিন ভ্যানরিকশায় প্রায় ১২ জন মিলে কোনওমতে গাইঘাটায় আসি।’’ সেখান থেকে অটো ধরে হাবরা আসেন আশিসবাবু। এরপরে হাবরা থেকে একটি ভিড়ে-ঠাসা বাসে বারাসত পৌঁছে যানজটে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পরে ভ্যান রিকশায় বারাসত স্টেশনে এসে সেখান থেকে একটি ট্রেন ধরে দমদমে পৌঁছন তিনি। রেলপথে বনগাঁ থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত ৭৭ কিলোমিটার যেতে সময় লাগে, সওয়া দু’ঘণ্টা থেকে আড়াই ঘণ্টা। কিন্তু সড়ক পথে‌ বনগাঁ থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ৬৭ কিলোমিটার পথ যেতেই লেগে যায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। তারপরে ভিআইপি রোড ধরে বিধাননগর, যশোররোড ধরে নাগেরবাজার হয়ে বেলগাছিয়া বা দমদম রোড ধরে দমদম মেট্রো স্টেশনে যেতে আরও অনেকটা সম লেগে যায়। ফলে ট্রেন ছাড়া যাতায়াত কার্যত দুঃস্বপ্ন বনগাঁ লাইনের বহু মানুষের কাছে।

এত গেল সময়ের কথা। হাবরা, দত্তপুকুর, বারাসত, মধ্যমগ্রাম, বিরাটি ও এয়ারপোর্টের যানজট এবং ৫টি রেলগেট পেরিয়ে বাড়তি এক-দু’ঘণ্টা আরও সময় লেগে যাওয়া নিত্য অভিজ্ঞতা এই এলাকার মানুষের কাছে। এরপরে রয়েছে খানাখন্দে ভরা রাস্তার ঝাঁকুনি এবং কঙ্কালসার রাস্তার ধুলোয় জেরবার অবস্থা। তা ছাড়া, পর্যাপ্ত বাস বা অন্য যানবাহন না থাকায় বাদুরঝোলা হয়ে ছাড়া বাসে চলাফেরার কার্যত কোনও উপায় থাকে না।

গোবরডাঙা, ঠাকুরনগরের মানুষরদের কাছে সেটুকু সুবিধাও নেই। সেখানে বাস না থাকায়, কোনওমতে তাদের আসতে হয় যশোর রোডে। কলকাতা যাওয়ার জন্য তারপর তাদের ধরতে হয় বনগাঁ থেকে আসা কোনও বাস। বছরের পর বছর ধরে এই যন্ত্রণার থেকে মুক্তি নেই কারও। বনগাঁ লোকালের বেশ কয়েক জন নিত্যযাত্রী মনে করেন, একে তো ট্রেন বাড়লে মাতৃভূমি লোকালে পুরুষ যাত্রীরা ওঠার দাবিও তুলতেন না। কারণ, তাঁতা সে ক্ষেত্রে অনেক স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারতেন। কিন্তু লোকাল ট্রেন না বাড়ায় কিংবা সব ট্রেন বারো বগির না হওয়ায় ভিড় ট্রেনে যাতায়াত নিত্যযাত্রীদের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া, সড়ক পথে যদি কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ সহজসাধ্য হতো, তা হলে রেলপথের উপরে চাপ কমত। আখেরে মাতৃভূমি লোকাল নিয়ে এত জলঘোলাও কখনওই হতো না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement