মধ্যপ্রদেশে যাতে জয়, তাতেই বিজেপির ভয় বাংলায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কটাক্ষ করেছিলেন ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’ বলে। কিন্তু সেই ‘সংস্কৃতি’কে কাজে লাগিয়েই মধ্যপ্রদেশে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হওয়া রুখে দিয়েছেন শিবরাজ সিংহ চৌহান। ‘রেউড়ি’ অর্থাৎ ‘খয়রাতি’। অর্থাৎ, আর্থিক সহায়তা। অর্থাৎ, জনমুখী আর্থিক সহায়তা প্রকল্প।
সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের আগে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ ‘লাডলি বহেন যোজনা’য় মহিলাদের আর্থিক সাহায্যের অঙ্ক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ভোটের ফলাফল বলছে, মধ্যপ্রদেশে যে যে কারণে বিজেপি তথা শিবরাজ নির্বাচনে জিতেছেন, তার অন্যতম বিপুল মহিলা ভোট।
তবে মধ্যপ্রদেশে যা বিজেপির ‘লাভ’ হয়ে দেখা দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তা বিজেপির ‘লোকসান’ হিসেবে ধেয়ে আসতে পারে লোকসভা ভোটে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজ্যের মহিলাদের জন্য বিবিধ জনমুখী প্রকল্প চালু করেছে। তার অন্যতম ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’। অনেকেই মনে করেন, মমতার থেকে শিক্ষা নিয়েই শিবরাজ মধ্যপ্রদেশে ‘লাডলি বহেন যোজনা’ চালু করেছিলেন। শিবরাজের সাফল্য থেকে শিক্ষা নিয়ে লোকসভা ভোটের মমতা তাঁর ‘ভান্ডার’ আরও প্রসারিত করবেন বলেই মনে করছেন তৃণমূলের নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের একটি অংশ। তাঁরা নিশ্চিত, এর ফলে রাজ্যের মা লক্ষ্মীরা মমতাকে আরও উপুড়হস্ত হয়ে আশীর্বাদ করবেন।
গত বিধানসভা ভোটে বাংলার মহিলারা দু’হাত ভরে ভোট দিয়েছিলেন মমতার তৃণমূলকে। তখন ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ শুধু প্রতিশ্রুতি ছিল। প্রকল্প চালু হয় মমতা তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর। যার পরে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, মহিলা ভোট বেশি গিয়েছে তৃণমূলে ঝুলিতেই। তৃণমূল মনে করছে, সেই ধারা লোকসভাতেও অব্যাহত থাকবে। রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘মহিলাদের অর্ধেক আকাশ বলা হয়। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের পূর্ণ বিকাশের কথা ভেবেছেন। তাই মহিলারা তাঁকেই চান।’’ প্রত্যাশিত ভাবেই একেবারে উল্টো অভিমত বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালের। তাঁর বক্তব্য, ‘‘রাজ্যের প্রকৃত বিকাশের পরিবর্তে তৃণমূল সরকার মহিলাদের কিনে নিয়েছে! কিন্তু তাঁদের সম্মান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লোকসভা ভোটে অন্যান্য রাজ্যের মতো বাংলাতেও মহিলারা তাই পদ্মেই ভোট দেবেন।’’
কন্যাশ্রীরাও তৃণমূলের আগামীর সম্পদ। — ফাইল চিত্র।
এ রাজ্যে ভোটার সংখ্যায় নারী-পুরুষ প্রায় সমান সমান। নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ হিসাব বলছে, লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে মোট ভোটার ৭,৫৩,৮৬,০৭২। এর মধ্যে মহিলা ভোটার ৩,৭০,৫২,৪৪৪। খসড়া ভোটার তালিকায় এই পরিসংখ্যান রয়েছে। হিসাব আরও বলছে, এই ভোটারদের অর্ধেকের বেশিই ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের সুবিধা পান। গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত নবান্নের হিসাব অনুযায়ী, রাজ্যে এই মুহূর্তে দু’কোটির বেশি মহিলা ওই প্রকল্পের সুবিধা পান। এর জন্য সরকার প্রতি মাসে খরচ করে ১,১৩৫ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, ওই প্রকল্পে তফসিলি জাতি এবং উপজাতি মহিলারা প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে পান। সাধারণ শ্রেণিভুক্ত মহিলারা পান মাসিক ৫০০ টাকা। এটা সকলেই পেতে পারেন। পারিবারিক রোজগার যা-ই হোক না কেন। রাজ্য সরকার এমন নিয়মও করেছে যে, ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পে যে মহিলাদের নাম রয়েছে, তাঁদের ৬০ বছর বয়স হয়ে গেলে এমনিতেই তাঁরা বার্ধক্যভাতা পাবেন।
নতুন মহিলা ভোটারদের সমর্থনও বিপুল পরিমাণে তৃণমূলে যাওয়ার কথা। কারণ ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প। এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল তৃণমূল সরকার দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরে। এর পরে ২০১৯-এর লোকসভা এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ‘কন্যাশ্রী’দের ভোট তারাই পেয়েছে বলে দাবি করে তৃণমূল। এই প্রকল্পে ১৩ থেকে ১৮ বছরের ছাত্রীদের বছরে এক হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। আর ১৮ বছরের আগে বিয়ে না হয়ে গেলে এককালীন ২৫ হাজার টাকা। সরকারের উদ্দেশ্য ‘বাল্যবিবাহ’ রোধ করা। কিন্তু এ-ও ঠিক যে, ২৫ হাজার টাকা হাতে আসে ঠিক সেই বয়সে, যখন সেই মেয়ে সদ্য ভোটার। এ ছাড়াও রয়েছে ‘রূপশ্রী’ প্রকল্প। ২০১৮ সাল থেকে বার্ষিক আয় দেড় লাখ টাকার কম, এমন পরিবারের বিবাহযোগ্যা কন্যার বিয়ের জন্য এককালীন ২৫ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য দেয় রাজ্য সরকার। সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যের ২,৭৬,০০,১৭৫ জন ছাত্রী ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের সুযোগ পান। মনে রাখতে হবে, তাঁদের মা-ঠাকুমারাও ভোটার। এ ছাড়াও তফসিলি জাতি, উপজাতি, সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি ভাগে মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা প্রকল্পের সুযোগ রয়েছে। উচ্চশিক্ষায় পরিবারের একমাত্র কন্যাসন্তানদের জন্যেও রয়েছে প্রকল্প।
রাজ্য সরকারের এই মুহূর্তে ৪০-এরও বেশি প্রকল্প রয়েছে। তার মধ্যে ‘বিধবাভাতা’ বা গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ‘মাতৃযান’ প্রকল্প ছাড়াও এমন অনেক সুযোগ-সুবিধা রাজ্য সরকার দেয়, যেখানে নারী-পুরুষ সমান সুবিধা পান। ফলে ‘অনিচ্ছুক’দের বাদ দিলে এই মুহূর্তে রাজ্যে এমন কোনও পরিবার নেই, যারা রাজ্য সরকারের প্রকল্প থেকে সরাসরি সুবিধা পায় না। স্ত্রী-কন্যা সুবিধা পাচ্ছেন দেখে পুরুষ ভোটাররাও খুশি হন! প্রায় সবক’টিতেই হাতে নগদ টাকা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। যদিও অগ্নিমিত্রার দাবি, ‘‘এটা তো আসলে হাতখরচ দিয়ে কিনে নেওয়া! কর্মসংস্থান তৈরি না করে ভোট কেনার চেষ্টা। বাংলার মহিলারা সেটা এখন বুঝতে পারছেন।’’ চন্দ্রিমার পাল্টা বক্তব্য, ‘‘মহিলারা ঠিক কী চান, সেটা মমতা বুঝতে পারেন। তিনি কষ্টটা ছুঁয়ে দেখতে পারেন এবং তা দূর করে মুখে হাসি ফোটাতে পারেন। তাই রাজ্যের সব প্রকল্পের মধ্যেই একটা মানবিক দিক রয়েছে।’’ চন্দ্রিমা জানাচ্ছেন, ‘সবুজসাথী’-র সাইকেল থেকে ‘যুবশ্রী’ প্রকল্পের মাসিক দেড় হাজার টাকা ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও পায়। কিন্তু ওই প্রকল্পগুলি মেয়েদের বেশি করে আত্মনির্ভর হতে সাহায্য করে। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর টাকা সংসারে মহিলাদের বক্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষিকা সুতপা চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এর পিছনে রাজনীতি রয়েছে কি না বলতে পারব না। তবে এটা মানতে হবে যে, এই সব প্রকল্প নারী ক্ষমতায়নের পক্ষে। পরিবারের মধ্যেও তো নারীর ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। অল্প হলেও সংসার খরচে অংশগ্রহণ গুরুত্ব তথা ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।’’ তাঁর মতে, শুধু আর্থিক অনুদানই নয়, সেই সঙ্গে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পে বিমার প্রথম নাম পরিবারের কোনও মহিলার করে দেওয়া, পঞ্চায়েত স্তরে ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ, বিভিন্ন নির্বাচনে মহিলাদের বেশি করে প্রার্থী করার মধ্যে দিয়েও তিনি যে মহিলাদের সম্মান দিচ্ছেন, তা বুঝিয়েছেন মমতা। সুতপা বলেন, ‘‘অনেকেই কোন প্রকল্পে টাকা পাচ্ছেন, সেটা জানেন না। বলেন, ‘মমতার টাকা’ পাচ্ছি।’’
মমতাকে ‘মহিলা সংরক্ষণের মা’ বলে আখ্যা দিয়ে লোকসভায় বক্তৃতা করেছিলেন তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার। বলেছিলেন, ‘‘লোকসভায় তৃণমূলের মহিলা সাংসদের সংখ্যা ৯। অর্থাৎ, আমাদের ৪০ শতাংশ সাংসদ মহিলা। বিজেপির মহিলা সাংসদের সংখ্যা মাত্র ১৩ শতাংশ।’’ লোকসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিল (যার পোশাকি নাম ‘নারীশক্তি বন্দন অধিনিয়ম’) সংক্রান্ত বিতর্কে অংশ নিয়ে কাকলি বলেছিলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলা সংরক্ষণ বিলের মা।’’
লোকসভা ভোটেও মমতা যে মহিলা ভোট টানবেন, তা এখন থেকেই বলে দিচ্ছেন শাসক শিবিরের প্রথম সারির নেতা-নেত্রীরা। বিভিন্ন আর্থিক সহায়তামূলক প্রকল্প তো আছেই, লোকসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশের পর দিনই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, আসন্ন লোকসভা ভোটে যাঁদের টিকিট দেওয়া হবে, তাঁদের ৫০ শতাংশ মহিলা হবেন বলে ভাবছে দল। অভিষেক বলেছিলেন, “মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ কী ভাবে করতে হয়, আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন৷ আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে ৫০ শতাংশ মহিলা প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে৷”
আর মমতা? এক ধাপ এগিয়ে এক বার বলেই ফেলেছিলেন, ‘‘আমি তো পারলে মহিলাদের জন্য ১০০ শতাংশই সংরক্ষণ করে দিতাম!’’