Farmers

কৃষকবধূ কেন ‘কৃষকবন্ধু’ হতে পারেন না?

সরকার মেয়েদের চাষির সম্মান দিয়েছে কি? কিসান ক্রেডিট কার্ড করাতে গিয়ে অনিলা শুনেছেন, কার্ড করার বয়স পেরিয়ে গিয়েছে।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২১ ০৬:৪০
Share:

প্রতীকী ছবি।

ছেলেমেয়ে যখন স্কুলে ঢুকল, তখন মাটির ভাঁড়ে টাকা জমানো শুরু করেছিলেন অনিলা মাহাতো। বয়স যখন ৪৬, ভাঁড় ভেঙে বেরোল ৬৫০০ টাকা। গয়না বেচে পেলেন আরও হাজার দুয়েক। তাই দিয়ে কিনলেন দেড় বিঘে জমি। কেন? নইলে সংসারে মান দেবে কেন ছেলে-বৌ? পুরুলিয়ার কোটশিলায়, চিরুগোড়া গ্রামের ৫৬ বছরের অনিলার ওই জমিটুকু বার্ধক্যের সম্বল, মর্যাদার প্রতীক।

Advertisement

সরকার মেয়েদের চাষির সম্মান দিয়েছে কি? কিসান ক্রেডিট কার্ড করাতে গিয়ে অনিলা শুনেছেন, কার্ড করার বয়স পেরিয়ে গিয়েছে। ভাগ্যিস ভোট এল, ‘দুয়ারে সরকার’ শিবির হল, তাই ‘কৃষকবন্ধু’-র ফর্ম জমা দিয়েছেন। এই প্রৌঢ়ত্বে হয়তো মহিলা পাবেন চাষির স্বীকৃতি।

কৃষি এ বার নির্বাচনের অন্যতম বিষয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হুঙ্কার দিচ্ছেন, কেন বাংলার চাষি ‘পিএম-কিসান’ থেকে বঞ্চিত? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গর্জন করছেন, বাংলার চাষি কেন্দ্রের মুখ চেয়ে নেই, ‘কৃষকবন্ধু’-র টাকা পাচ্ছেন। কোনও দল প্রকাশ করছে না, কৃষক অনুদান পাচ্ছে কতজন মেয়ে? তথ্যের অধিকার আবেদনে চমকপ্রদ তথ্য সামনে এসেছে। পঞ্জাবের কৃষি আন্দোলনে মেয়েদের যোগদান নিয়ে এত শোরগোল, কিন্তু সেখানে ‘পিএম-কিসান’ পান ২৩ লক্ষ পুরুষ, আর মাত্র ৬১জন মেয়ে (নভেম্বর, ২০২০)। উত্তরপূর্ব ভারত ছাড়া, কোথাও মেয়েরা অর্ধেক অংশিদারির কাছাকাছি নেই। দেশের গড় চার জনে একজন। রাজ্য কৃষি দফতর সূত্রে খবর, এ রাজ্যে ৫৯ লক্ষ ‘কৃষকবন্ধু’ প্রাপকদের ২৪.৭ শতাংশ মহিলা।

Advertisement

অথচ, দশ জন খেতমজুরের সাত জনই মেয়ে। ধান পোঁতা থেকে ধান কাটা, তাদের শ্রম ছাড়া হয় না। পরিবারের জমি হলে মিনিমাগনা শ্রম। আর অন্যের খেতে? কোচবিহারের শীতলকুচি, পুরুলিয়ার আড়শা থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং, সর্বত্র মেয়েরা ফুঁসছে —পুরুষদের চাইতে তাদের মজুরি অন্তত ৫০ টাকা কম। “গত বছর আমরা ৫০জন মেয়ে ১৫ দিন স্ট্রাইক করেছিলাম,” বললেন ক্যানিং ২ ব্লকের দেবী হালদার। কাজ হয়নি। পাশে দাঁড়ায়নি কোনও দল। কোচবিহারে প্রমীলা বাহিনী বহু বার সমান মজুরি চেয়ে ধর্না দিয়েছে ব্লক অফিসে। “বিডিও বদলে যায়, মজুরি বদলায় না,” বললেন নেত্রী সাজিদা পারভিন।

তা বলে মেয়েরা খেতমজুরিতে থেমে নেই। ‘প্রমীলা বাহিনী অ্যাগ্রোপ্রোডিউসার্স কোম্পানি’-র সদস্য কোচবিহারের পাঁচটা ব্লকের ৫১২ জন মেয়ে। মাছ চাষ, ছাগল পালন করছে, ভুট্টা-হলুদ ফলাচ্ছে। ক্যানিং-এও মেয়েরা ‘ফার্মার্স ইন্টারেস্ট গ্রুপ’ তৈরি করে চাষ করছে। কিন্তু এ সব সরকারি স্কিম যেন মেয়েদের সান্ত্বনা পুরস্কার — ঋণ-অনুদান, জৈব সার ফ্রি নাও, জমি-পুকুর ঠিকা নিয়ে চাষ করো, কোম্পানি তৈরি করে বিক্রি করো। জমির মালিকানাটি চেয়ো না।

এই রাজনীতি মেয়েদের মুক্তি দেবে? ভাগচাষি যাতে উচ্ছেদ না হয়, তার জন্য বাম আমলে ভূমি সংস্কার হল। কিন্তু
আশি-নব্বইয়ের দশকে কৃষিজমির পাট্টায় বাদ পড়ল মেয়েরা। লক্ষ লক্ষ চাষি মেয়ে উচ্ছেদ হয়েছে শ্বশুরের জমি, ভিটে থেকে। জমির মালিকানা থাকলে হত কি? তৃণমূল স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে মেয়েদের নাম রেখেছে ‘পরিবারের প্রধান’ হিসেবে। অথচ, গ্রামীণ অর্থনীতির যা শিরদাঁড়া, সেই কৃষিতে বাদই থাকছে মেয়েরা। “মেয়েদের নামে স্বামী-শ্বশুর জমি না দিক, সরকার তাদের নাম রাখুক কৃষকবন্ধুতে,” দাবি করলেন সাজিদা। আর দেবী বলছেন, “পরিবারের জমিতে মেয়েরা কত শ্রম দেয়, সরকার কি জানে না? তা হলে ‘কৃষকবন্ধু’ স্বীকৃতি স্বামী-স্ত্রী, দু’জনেই পাবে না কেন?”

অর্থনীতিবিদ নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করেন, পরিবারের জমিতে মেয়েদের অধিকার স্বীকার করা দরকার। “মেয়েদের নাম ‘পিএম-কিসান’ কিংবা ‘কৃষকবন্ধু’-তে থাকলে তাদের উপর গার্হস্থ্য নির্যাতন কমবে। তারা কৃষক পেনশন পাবে। চাষের প্রশিক্ষণ নিয়ে উৎপাদন বাড়াবে। পুরুষরা বাইরে যাচ্ছে কাজে, এখন চাষ তো নারী-নির্ভর।”

অর্ধেক চাষি যে দিন হবে মেয়ে, সে দিন সত্যিই নির্মূল হবে জমিদারি প্রথা। সে রাজনীতি করার সাহস আছে কার?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement