North Kolkata TMC

তৃণমূলের ‘ক্ষত’ সারে না কোনও কিছুতেই! ফিশফ্রাই বা নারকেল নাড়ু ‘সাময়িক মলম’, কলকাতা উত্তর কখনও স্থায়ী উত্তর দেয় না

তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে উত্তর কলকাতায় দলের মধ্যে নানা সমীকরণ ছিল। অজিত পাঁজার সঙ্গে সাধন পাণ্ডের কোন্দল ছিল সুবিদিত। কিন্তু কখনওই তা এই পর্যায়ে যায়নি। উত্তর নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই তৃণমূলে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৫ ০৮:৫৭
Share:

(বাঁ দিক থেকে) অজিত পাঁজা, সাধন পাণ্ডে, শশী পাঁজা, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কুণাল ঘোষ। ফাইল চিত্র।

মাঝেমধ্যেই প্রকাশ্যে চলে আসে ‘ক্ষত’। সামনে নির্বাচনের মতো মাহেন্দ্রক্ষণ থাকলে সেই ক্ষতে মলম দেওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু কয়েক মাস কাটতে না কাটতে ফের তা দগদগে হয়ে বেরিয়ে আসে। সেই ক্ষতের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ‘অঙ্গহানি’ও ঘটেছে।

Advertisement

গত কয়েক বছর ধরে উত্তর কলকাতার তৃণমূলে এটাই নিয়ম! কেন সেই ক্ষত স্থায়ী ভাবে সারিয়ে তোলা যায় না? কেন সাময়িক জোড়াতাপ্পি দিয়ে আরও দগদগে হওয়ার অবকাশ রাখা হয়? এবম্বিধ প্রশ্ন রয়েছে তৃণমূলের অন্দরেও। তার উত্তরে মিলছে নানাবিধ ব্যাখ্যা।

ঘটনাচক্রে, এমন সময়ে উত্তর কলকাতার তৃণমূলের পুরনো ক্ষত নতুন করে প্রকাশ্যে এসেছে, যখন তৃণমূলে একাধিক সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বদল হওয়া সময়ের অপেক্ষা। গত শনিবার প্রায় ৪,৫০০ নেতাকে নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠকে সে কথা জানিয়ে দিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘটনাচক্রে, অভিষেক তাঁর বক্তৃতায় যে সব এলাকায় ‘সাংগঠনিক দুর্বলতা’র কথা উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে জোড়াসাঁকো এবং চৌরঙ্গি। দু’টি বিধানসভাই দলের প্রবীণ নেতা তথা উত্তর কলকাতার সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্রের অন্তর্গত। তার মধ্যে চৌরঙ্গির বিধায়ক সুদীপের স্ত্রী নয়না। ফলে জল্পনা তৈরি হয়েছে উত্তর কলকাতার জেলা সভাপতি বদল নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন, সুদীপ ফের স্বপদে থেকে যাবেন। কারও মুখে অন্য এক নেতার কথা। ইঙ্গিতে তাঁরা বলছেন, ‘‘ওই নেতাকে সভাপতি করলে তবেই সংগঠনের জীবন ফিরবে।’’

Advertisement

ফিরবে কি? তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে উত্তর কলকাতায় দলের মধ্যে নানা সমীকরণ ছিল। অজিত পাঁজার সঙ্গে সাধন পাণ্ডের কোন্দল ছিল সুবিদিত। তবে তৃণমূলের প্রবীণ নেতাদের অনেকেই বলছেন, অজিত যখন উত্তর-পূর্বের (তখন উত্তর কলকাতায় দু’টি লোকসভা ছিল। উত্তর-পূর্ব এবং উত্তর পশ্চিম) সাংসদ ছিলেন, তখন তাঁর শক্তিতে কাউন্সিলরেরা জিততেন। আর সুদীপকে কাউন্সিলরেরাই জেতান। মৌলিক ফারাক সেখানেই। তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, অজিতের কারণেই উত্তর-পূর্বে ‘স্থিতাবস্থা’ থাকলেও উত্তর-পশ্চিমে ছিল না। অবিভক্ত কংগ্রেসে কখনও দেবী পাল ছিলেন নেতা। আবার তৃণমূল তৈরি হওয়ার পর কখনও সুদীপ, কখনও সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে দাঁড় করিয়ে নেতৃত্বের বদল করা হয়েছিল। ফলে সংগঠনে, নিচুতলার নেতাদের মধ্যেও ‘অস্থিরতা’ ছিল। উত্তর কলকাতায় কংগ্রেসি ঘরানার রাজনীতি করে তৃণমূলে যোগ দেওয়া অনেকের বক্তব্য, সার্বিক ভাবে নেতৃত্বের মানের ‘অবনমন’ ঘটেছে। অতীতে যখন অজিত-সাধন দ্বন্দ্ব ছিল, তখনও তার একটা ‘মান’ ছিল। কিন্তু এখন সেটা নেই। অবক্ষয় সার্বিক। আবার অনেকের বক্তব্য, দক্ষিণ কলকাতার রাজনীতিতে তৃণমূলের আরও বড় নেতারা রয়েছেন। কিন্তু সেখানে এই দ্বন্দ্ব এত প্রকট নয়। কারণ, সারা ক্ষণ মমতার নজরদারি রয়েছে।

১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিমে তৃণমূল সাংসদ ছিলেন সুদীপ। কিন্তু ২০০৪ সালে সুদীপকে সরিয়ে মমতা ওই কেন্দ্রে প্রার্থী করেন সুব্রতকে। টিকিট না পেয়ে সুদীপ জোড়া মোমবাতি চিহ্নে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে ভোট কেটে নিয়েছিলেন। সেই কাটাকুটির অঙ্কে জিতে গিয়েছিলেন সিপিএমের সুধাংশু শীল। আবার এই সুদীপ যখন ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের প্রাক্পর্বে তৃণমূলে ফেরার উদ্যোগ নেন, তখন মমতার সঙ্গে তাঁর ‘সেতুবন্ধন’ করিয়ে দিয়েছিলেন কুণাল ঘোষ।

সেই কুণালের সঙ্গেই সুদীপের দ্বন্দ্ব আবার নতুন করে প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। কুণাল সমাজমাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন, সুদীপ কি ‘অসুস্থ’? সাংসদ তথা উত্তর কলকাতা তৃণমূলের সভাপতি সুদীপ নিজে কোনও জবাব দেননি। তাঁর বিধায়ক সহধর্মিণী নয়না দাবি করেন, সুদীপ একদমই সুস্থ। কুণালের কাছে ‘ভুল তথ্য’ রয়েছে। কুণাল আবার জোর দিয়ে বলেন, তিনি যখন বলেছেন সুদীপ অসুস্থ, তখন সুদীপ অসুস্থই! ভুল তথ্য রয়েছে নয়নার কাছে। কুণালের দাবি, সুদীপকে ইঞ্জেকশনও দিতে হচ্ছে।

সাধারণ ভাবে রাজনীতিকেরা কেউই নিজেকে ‘অসুস্থ’ বলতে চান না। তাতে জনমানসে তাঁদের কর্মক্ষম ভাবমূর্তি ধাক্কা খায়। কিন্তু এই অসুস্থতার বিষয়টিকে ‘উপসর্গ’ হিসাবেই দেখছেন শাসকদলের অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, আসল ‘রোগ’ আরও গভীরে, যা উত্তর কলকাতার পুরনো তৃণমূলের পুরনো ‘অসুখ’। এই রোগের স্থায়ী চিকিৎসা প্রয়োজন। উত্তর কলকাতার তৃণমূলের হালহকিকত সম্পর্কে সম্যক অবহিত এক নেতার কথায়, ‘‘ফোড়া হলে আমরা ফাটিয়ে দিয়ে ভাবি সেরে গেল। কিন্তু ওখানেই আবার ফোড়া হয়।’’

মাঝে উত্তর কলকাতার সংগঠনকে ‘সক্রিয়’ করতে সুদীপকে জেলা সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুদীপের বদলে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাপস রায়কে। আবার সুদীপের আর্জিতেই তাপসকে সরিয়ে তাঁকে জেলা সভাপতির পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সুদীপ জেলা সভাপতি পদ ফিরে পেতে নিজেই যে ‘তদ্বির’ করেছিলেন, তা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন মমতা। উত্তর কলকাতার রাজনীতিতে তাপস-সুদীপ দ্বন্দ্বও ছিল সুবিদিত। যে দ্বন্দ্বের ফলে গত লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছিলেন তাপস। প্রার্থীও হয়েছিলেন। কিন্তু সুদীপের কাছেই হারতে হয় তাঁকে।

২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাদিবসের দিন উত্তর কলকাতাই ছিল শাসকদলের অন্দরে বিতর্কের কেন্দ্রে। কুণাল দাবি তুলেছিলেন, উত্তর কলকাতায় ‘মহিলা প্রার্থী’ চাই। রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজার নামও বলেছিলেন তিনি। এমনকি, নয়নাতেও আপত্তি ছিল না তাঁর। কুণালকে সমর্থন করে সুদীপকে ‘নন প্রোডাক্টিভ সাদা হাতি’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন তাপস। কোন্দল মেটাতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল স্বয়ং মমতাকে। তার পর এক দিন বিকালে কুণালকে বাড়িতে ডেকে ফিশফ্রাই এবং নিজের হাতে বানানো নারকেল নাড়ু খাওয়ান নয়না। ছিলেন সুদীপও। কিন্তু তা যে সাময়িক ‘মলম’ ছিল, তা আবার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে ২০২৫ সালের মার্চ মাসে। অভিজ্ঞেরা বলছেন, ‘‘ফিশফ্রাই-নাড়ু ছিল ফোড়া ফাটিয়ে দেওয়ার মতো। দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা হয়নি। রোগও সারেনি। আবার ফোড়া তৈরি হয়েছে।’’

তবে কোনও বিবাদ বা বিতর্কের সময়েই সুদীপ নিজে মুখ খোলেননি। এ বারেও নয়। বক্তব্য পেশ করেছেন নয়না। তবে সুদীপের বিরোধীরা বলেন, নেত্রীকে হোয়াট্‌সঅ্যাপে ক্রমাগত ‘নালিশ’ করতে থাকেন সুদীপ।

শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশন থেকে ভূপেন বোস অ্যাভিনিউয়ের ফটক দিয়ে বেরোলে বাঁ দিকে যে তস্যগলি চলে গিয়েছে, সেটির নাম গৌরীমাতা সরণি। সেই রাস্তায় গত লোকসভা ভোটের সময়কার একটি দেওয়াল লিখন এখনও স্পষ্ট। তৃণমূলের জোড়াফুল প্রতীকের সঙ্গে সুদীপের নামের পাশে লেখা, ‘উত্তরের উত্তর’।

কিন্তু তৃণমূলের দেওয়ালের অদৃশ্য লিখন তা বলছে না। বলছে, কলকাতা উত্তরে প্রশ্ন অনেক। স্থায়ী কোনও উত্তর নেই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement