গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বেশ কিছু দিন ধরেই তিনি ‘অসুস্থ’। শ্বাসকষ্ট এবং বুকে ব্যথার কারণে গত এক বছরে একাধিক বার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে তাঁকে। পরীক্ষায় ধরা পড়েছে উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ফিশচুলা-সহ আরও একাধিক সমস্যা। কিন্তু তা সত্ত্বেও সোমবার এসএসকেএম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল ভর্তি করল না তৃণমূলের ‘দাপুটে’ নেতা অনুব্রত মন্ডলকে। সূত্রের খবর, কয়েক দফা শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেখানকার চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতির শরীরে পুরনো কিছু সমস্যা আছে বটে। তবে তার জন্য তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করাতে হবে না।
অনুব্রতের ঘটনাক্রম বলছে, গত ৬ এপ্রিল সিবিআইয়ের তলবের পরে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তৃণমূলের এই নেতা। সোমবারও তাঁর জন্য উডবার্ন ব্লকের ২১৬ নম্বর কেবিনটি প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। অসমর্থিত সূত্রের খবর, সাত চিকিৎসকের একটি দল অনুব্রতকে পরীক্ষা করেন। তার মধ্যে কয়েক জন অনুব্রতকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করানোর পক্ষে মত দেন। কিন্তু বাকিরা ইসিজি, সুগার পরীক্ষা, রক্তচাপ এবং পাল্স অক্সিমিটার দিয়ে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রার রিপোর্টের ভিত্তিতে জানান, অনুব্রতকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করানোর কোনও প্রয়োজন নেই।
ঘটনাচক্রে, সোমবারই গরুপাচার মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনুব্রতকে তলব করেছিল সিবিআই। তার আগে রবিবার তৃণমূল নেতা ইমেল মারফত সিবিআইকে জানিয়েছিলেন, সোমবার তাঁর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁর আইনজীবী জানান, অনুব্রত অসুস্থ। রবিবার বীরভূম থেকে কলকাতায় আসবেন। তবে সেটা এসএসকেএমে চিকিৎসা করানোর জন্য।
যার জবাবে সিবিআই বলেছিল, এসএসকেএমে চিকিৎসার পরে হলেও নিজাম প্যালেসে জেরার জন্য যেতে হবে অনুব্রতকে। সিবিআইয়ের সেই ‘নির্দেশ’ পালন না করেই অবশ্য সোমবার বিকেলে বীরভূম পাড়ি দিয়েছেন এসএসকেএম হাসপাতালে ‘প্রত্যাখ্যাত’ কেষ্ট।
সিবিআইয়ের তলব পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনা আগেও ঘটেছে অনুব্রতের ক্ষেত্রে। এ বারেও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারত। কিন্তু বাস্তবে তা হল না। দেখা গেল, এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ রায় দিলেন, অনুব্রতের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই।
যা দেখেশুনে অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ার পরের ঘটনাক্রমের কথা। তখনও তিনি রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন।
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় গত জুলাই মাসে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) গ্রেফতার করে পার্থকে। ব্যাঙ্কশাল আদালতের অনুমোদন অনুযায়ী পার্থকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা ইডি নিম্ন আদালতের সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বিবেক চৌধুরীর বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, পার্থকে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে ভুবনেশ্বর এমসে নিয়ে গিয়ে শারীরিক পরীক্ষা করাতে হবে। ঘটনাচক্রে, ওই রায় দেওয়ার সময় বিচারপতি চৌধুরী তাঁর লিখিত পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, ‘যখনই সাম্প্রতিক কালে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে অথবা তদন্তকারী আধিকারিক বা সংস্থার সামনে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে, তাঁরা তখনই এসএসকেএম হাসপাতালের আশ্রয় নিয়েছেন’।
এসএসকেএম হাসপাতালকে ‘প্রভাবশালীদের নিরাপদ স্থান’ বলে চিহ্নিত করে হাই কোর্টের ওই পর্যবেক্ষণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে ‘স্বস্তিজনক’ হওয়ার কথা ছিল না। সেই অস্বস্তি আরও বাড়ে গত ২৫ জুলাই এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে ভুবনেশ্বর উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে পার্থের শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষার পর। সেখানকার এমস জানিয়ে দেয়, পার্থের শরীরে পুরনো কিছু সমস্যা থাকলেও তা তেমন মারাত্মক কিছু নয়। এ জন্য তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে না। ওই পরীক্ষানিরীক্ষার সময় সেখানে এসএসকেএমের চিকিৎসকেরাও ছিলেন।
ভুবনেশ্বর এমসের চিকিৎসকদের ওই সিদ্ধান্তের পরে নানা মহলে সমালোচনার মুখে পড়েছিল পূর্ব ভারতে চিকিৎসার ‘উৎকর্ষকেন্দ্র’ বলে পরিচিত এসএসকেএম। প্রশ্ন উঠেছিল সংস্থার ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের ‘পেশাগত সততা’ নিয়েও। সে সময় এসএসকেএমের চিকিৎসক তুষারকান্তি পাত্র দাবি করেছিলেন, তাঁদের এবং ভুবনেশ্বর এমসের শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্টে তেমন কোনও ফারাক নেই। দু’দিনের মধ্যে পার্থের শারীরিক অবস্থা কিছুটা ভাল হওয়ার কারণেই এমস কর্তৃপক্ষ সম্ভবত তাঁকে ভর্তি করাননি। এসএসকেএম পার্থকে দেখেছিল দিন দুয়েক আগে। তখন তাদের যেমন মনে হয়েছিল, তারা তেমন রিপোর্ট দিয়েছিল। দিন দুয়েকে পার্থের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়ে থাকতে পারে। সে কারণেই ভুবনেশ্বের এমন পার্থকে ভর্তি করানোর দরকার আছে বলে মনে করেনি।
কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি চৌধুরীর পর্যবেক্ষণের পর এসএসকেএম হাসপাতাল এবং সেখানে ‘প্রভাবশালী’-দের ভর্তি হওয়া নিয়ে জনতার একটি অংশে জল্পনা এবং আলোচনা শুরু হয়েছে। পার্থ-কাণ্ডের পরে সেই আলোচনা আরও বেড়েছে। যদিও তার মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসএসকেএম হাসপাতালকে ‘দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে, হাসপাতালের ডিরেক্টরকে সম্প্রতি ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মাননাও দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে।