সিউড়ি আদালতে। নিজস্ব চিত্র
বারবার মহম্মদবাজার। আদিবাসী মহিলাদের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে পরপর মহম্মদবাজারের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠছে, কেন এমন ঘটনা সেখানে ঘটেই চলেছে।
ভিন্ জাতের যুবকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ‘অপরাধে’ স্বামীহারা এক আদিবাসী মহিলাকে গণধর্ষণের অভিযোগ সামনে আসে শনিবার। সালিশি সভা বসিয়ে জরিমানা আদায়েরও অভিযোগ উঠেছে মহম্মদবাজারের চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ওই ঘটনায়। অনেকে এই ঘটনার সঙ্গে সাত বছর আগে ঘটে যাওয়া বীরভূমেরই লাভপুর থানার সুবলপুর গ্রামের গণধর্ষণের ঘটনার মিল খুঁজে পাচ্ছেন। পুলিশি তৎপরতায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেন মহম্মদবাজার থানা এলাকায় একাধিক গণধর্ষণের ঘটনা ঘটছে সেই প্রশ্নও উঠছে।
জেলা পুলিশের তথ্যই বলছে, গত দু’বছরে মহম্মদবাজারে চারটি গণধর্ষণের অভিযোগ সামনে এসেছে। সব ক’টি ক্ষেত্রেই নিগৃহীতা হয়েছেন আদিবাসী মহিলারা। কখনও নাবালিকা, কখনও তরুণী, কখনও বধূ, আবার কখনও স্বামীহারা মহিলার উপরে অত্যাচার হয়েছে। অভিযুক্তদেরও প্রায় সকলেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। গত বছর ১৭ ডিসেম্বর এক নাবালিকাকে পাথর শিল্পাঞ্চলের পরিত্যক্ত খাদানে নিয়ে গিযে গণধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল তার প্রেমিক ও চার সঙ্গীর বিরুদ্ধে। পক্সো আইনে মামলা হয়। ধরাও পড়ে অভিযুক্তরা। বিচার পর্ব শুরু হওয়ার আগেই চলতি বছরের জানুয়ারিতে আত্মঘাতী হয় ওই নাবালিকা। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েতের উদয়ডিহি গ্রাম সংলগ্ন জঙ্গলে শালপাতা ও মাশরুম তুলতে ঢুকে দলছুট হতেই এক আদিবাসী বধূকে কয়েক জন যুবক গণধর্ষণ করে বলে অভিযোগ হয়। তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু অভিযুক্তদের পরিবারের তরফে ক্রমাগত হুমকিতে গ্রামের মধ্যে তাঁকে একঘরে করে দেওয়া হয়েছে—এই অভিযোগ নিয়ে জেলাশাসকের দ্বারস্থ হন নির্যাতিতা।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেও গণধর্ষণের অভিযোগ উঠে মহম্মদবাজারে। অভিযোগ ছিল, ঝাড়খণ্ডের রানিশ্বর থানা এলাকার বাসিন্দা স্বামী বিচ্ছিন্না আদিবাসী তরুণীকে সেকেড্ডার গোপালনগর জঙ্গল লাগোয়া পাম্পহাউসে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে তাঁর এক পূর্বপরিচিত ও তার তিন সঙ্গী।
আদিবাসী সংগঠন, বুদ্ধিজীবী বা সাংস্কৃতিক কর্মীরা এর কারণ হিসেবে দায়ী করছেন পাথর শিল্পাঞ্চলে কাঁচা টাকা, নানা প্রলোভনের হাতছানি, স্মার্ট ফোনের অপব্যবহার, নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ার মতো ঘটনার জেরে নেমে আসা সামাজিক অবক্ষয়কে। ভারত জাকাত মাঝি পারগনা মহলের সম্পাদক নিত্যানন্দ হেমব্রম বলেন ‘‘বীরভূমে আমাদের সংগঠন দুর্বল। অন্য সংগঠনও চাঙ্গা নয়, ফলে এই প্রলোভন আটকে সামাজিক অবক্ষয় রোধে যে ভূমিকা নেওয়া উচিত সেটা নেওয়া যাচ্ছে না।’’
প্রায় একই ইঙ্গিত গাঁওতা নেতা সুনীল সরেনের। তিনি বলছেন, ‘‘শিল্পাঞ্চল হওয়ায় কাঁচা টাকা আর নানা প্রলোভন রয়েছে। যুব সমাজ বিচ্যুত হচ্ছে। এ ছাড়া বাইরে থেকে বহু মানুষের আনাগোনায় মিশ্র সংস্কৃতি আদিবাসী সমাজের শক্ত কাঠমোকে দুর্বল করে দিয়েছে।’’ সুনীলের সংযোজন, ‘‘এর সঙ্গে রাজনীতির প্রভাবে একটি আদিবাসী গ্রামে একাধিক মাঝি হারামের উপস্থিতি তাঁদের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সমাজের উপরে মোড়লদের নিয়ন্ত্রণ আরও আলগা হয়েছে।’’ উভয়ের বক্তবের সঙ্গে সহমত সাংস্কৃতিক কর্মী লক্ষ্মণ হাঁসদাও।
অন্য দিকে, গাঁওতা নেতা রবীন সরেন বলছেন, ‘‘শিল্পাঞ্চল হলেও ব্লকের যে এলাকায় এমন ঘটনা ঘটেছে তার সর্বত্র কাঁচা টাকা আসছে, তেমন নয়। তবে অস্বীকার করা যাবে না আদিবাসী সমাজে অবক্ষয় নেমেছে। নেশা ও স্মার্ট ফোনের অপব্যবহার এই অবক্ষয়ের জন্য অনেকাংশ দায়ী।’’