বাম জমানায় মহাকরণের আসল দখল ছিল কো-অর্ডিনেশন কমিটির হাতেই। ছবি: শাটারস্টক।
নচিকেতা চক্রবর্তী তাঁদের নিয়ে গান বেঁধেছিলেন। সেখানে লিখেছিলেন, ‘‘হপ্তায় হপ্তায় আন্দোলনের খেলা, টি-এ, ডি-এ বাড়ানোর জন্য। ফি মাসে যদি এক দিনও কাজ করি, অফিসটা হয়ে যায় ধন্য।’’
তাঁরা রাজ্য সরকারি কর্মচারী। বাম জমানায় যাঁরা ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ। মহাকরণের অলিন্দে নিত্যদিন কোনও না কোনও দাবিতে তাঁদের মিছিল করতে দেখা যেত। পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ হয়ে থাকত প্রতিটি দফতর। কর্মচারীদের একটা বড় অংশ নিজের কাজের জায়গার থেকে বেশি সময় কাটাতেন মহাকরণের মধ্যে সংগঠনের দফতরে। সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকত অবশ্যই কো-অর্ডিনেশন কমিটির জন্য বরাদ্দ বড় ঘরটিতে।
বকেয়া মহার্ঘভাতার দাবিতে সোম এবং মঙ্গলবার মিলিয়ে ৪৮ ঘণ্টা কর্মবিরতি ডেকেছে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের যৌথ মঞ্চ-সহ ৩২টি সংগঠন। কর্মবিরতির প্রথম দিনে অন্তত কো-অর্ডিনেশন কমিটির দেখা মেলেনি সেই আন্দোলনে। দ্বিতীয় দিন, মঙ্গলবার এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা তাদের। মহার্ঘভাতার প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের তুলনায় এমনিতেই অনেক পিছিয়ে ছিলেন রাজ্যের কর্মচারীরা। সেই পরিস্থিতিতে তাঁদের জন্য ৩ শতাংশ মহার্ঘভাতা ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু তাতে খুশি নন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আগেই অবস্থান-অনশন শুরু হয়েছিল। ৩ শতাংশ বৃদ্ধির ঘোষণার পর পাল্টা ডাকা হয়েছে কর্মবিরতি।
কিন্তু এই আন্দোলনের পুরোভাগে তো দূরস্থান, সাইডলাইনেও সে ভাবে দেখা যায়নি বাম আমলের সরকারি দফতরে যাদের নির্দেশে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত, সেই সংগঠনকে। আন্দোলনের ময়দানে তারা পিছিয়ে। কলকাতার শহিদ মিনার চত্বরে সরকারি কর্মীদের ১১ দিন পার করা ধর্না-অবস্থান-অনশনে সমর্থন থাকলেও মঞ্চ থেকে অনেক দূরে কো-অর্ডিনেশন কমিটি। বামফ্রন্ট রাজ্যের ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরে একটু একটু করে ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে সংগঠন। নিয়মরক্ষার আন্দোলনে থাকলেও সরকারি কর্মীদের পাশে কি আর আদৌ রয়েছে একদা সিংহরূপী কো-অর্ডিনেশন কমিটি? অনেকে বলছেন, সিংহ অনেক দূরের কথা! এখন আর তাদের বিড়ালের তেজও নেই।
জ্যোতি বসুও নিয়মে বাঁধতে পারেননি সরকারি কর্মচারীদের। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
ক্ষমতা বদল হতেই কো-অর্ডিনেশন কমিটির থেকে সরকারি কর্মচারীরা যে দূরত্ব তৈরি করেছেন, তা অবশ্য মানতে চান না সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। বরং তাঁর দাবি, সংগঠনকে দুর্বল বানাতে তৃণমূল সরকার এক ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সোমবার সেলিম বলেন, ‘‘সংগঠন দুর্বল হয়েছে, এমন দাবি ঠিক নয়। গত দশ বছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সংগঠনকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছেন। নেতাদের উপর বদলির খাঁড়া, চাকরি যাওয়ার খাঁড়া ঝোলানো হয়েছে। সংগঠনের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের দূরদূরান্তে বদলি করে দেওয়া হয়েছে।’’ তবে পাশাপাশিই সেলিমের দাবি, ‘‘এত কিছু করেও কর্মীদের মনোবল ভাঙতে পারেনি সরকার। সংগঠন এখনও লড়াইয়ের মধ্যেই আছে। সর্বত্র চেষ্টা চললেও পুলিশ ছাড়া অন্য কোনও জায়গায় বাম শ্রমিক ও কর্মচারী সংগঠন ভাঙা যায়নি।’’
সেলিম শুধু তৃণমূল সরকারকে দায়ী করলেও সরকারি কর্মীরা কিন্তু অন্য কথা বলছেন। রাজ্যে ক্ষমতাবদলের প্রভাব যে কো-অর্ডিনেশন কমিটির উপরে পড়েছে, সেটা মেনে নেওয়ার পাশাপাশিই তাঁরা বলছেন, বাম জমানার শেষ দিকেই কো-অর্ডিনেশন কমিটির শক্তি ও সরকারি কর্মচারীদের উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ কমতে শুরু করেছিল। বর্তমান জমানায় যা প্রকট হয়ে উঠেছে।
এ রাজ্যে সরকারি কর্মীদের সম্পর্কে ‘আসি যাই, মাইনে পাই’ প্রবাদ তৈরির পিছনেও কো-অর্ডিনেশন কমিটির বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। একটা সময়ে এমন ধারণাও কর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল যে, এই বাম সংগঠনের ছত্রছায়ায় থাকা মানে কাজ না করেও সরকারের কোপে পড়তে হবে না। বদলি আটকানো যাবে, এগিয়ে আনা যাবে পদোন্নতি।
কর্মসংস্কৃতি বদলাতে চেয়েছিলেন। পেরেছিলেন কি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য? ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে অবসপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি কর্মী প্রবীর দত্তগুপ্ত বলছেন, ‘‘আমাদের সময়ে একটা অংশের কর্মীরা অফিসে এসে টেবিলে ব্যাগ রেখেই চলে যেতেন। টিফিন আওয়ার্সের পরে অনেকের দেখাই পাওয়া যেত না। দলীয় সভা-সমিতি থাকা মানে তো সবেতন ছুটি। তার জন্য কোনও ছুটিও কাটা যেত না।’’ সেই সূত্রেই প্রবীরবাবুর বক্তব্য, গায়ক নচিকেতা ‘আমি সরকারি কর্মচারী’ গানটা সঠিকই লিখেছিলেন।
সেই সময়ে নিয়মিত মহাকরণে যাওয়া এক প্রবীণ সাংবাদিকের কথায়, ‘‘জ্যোতি বসুর সময়ে কো-অর্ডিনেশন কমিটির দাপট এতটাই বেশি ছিল যে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। এক বার আক্ষেপের সুরেই বলেছিলেন, কাকে কাজ করতে বলব? টেবিল-চেয়ারকে? সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। এখন সংগঠন করলে সবেতে ছাড়— এমন পরিবেশটাই নেই।’’
কো-অর্ডিনেশন কমিটি নামে বিভিন্ন সংগঠনের মিশেল হলেও সিপিএম পরিচালিত করণিকদের সংগঠন হয়ে উঠেছিল। ‘সি’ গ্রেডের কর্মীদের সমর্থনই ছিল কো-অর্ডিনেশন কমিটির মূল সম্পদ। সেই সময় নির্বাচনে এই অংশের উপরে অনেকটাই নির্ভর করতে হত শাসকদলকে। এখন নির্বাচনে নজরদারি অনেক বেড়েছে। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত ভোটার তালিকায় ভুয়ো ভোটার ঢোকানো থেকে ভোটগ্রহণ এবং গণনায় কারচুপির ক্ষেত্রেও সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠত। এখন সেই পরিস্থিতি নেই বলেই সব কর্মচারী সংগঠনের গুরুত্ব অনেকটাই কমে গিয়েছে।
বিরোধীরা তখন বার বার অভিযোগ তুলতেন, ভোটে কারচুপির জন্য সরকারি কর্মচারীদের ‘ব্যবহার’ করছে ক্ষমতাসীন সিপিএম তথা বামফ্রন্ট। একটা বড় সময় পর্যন্ত রাজ্যে সে ভাবে কোনও বিরোধী শক্তি ছিল না। ফলে এটা এক প্রকার নিশ্চিত ছিল যে, ভোট হলে বামফ্রন্টই ফিরবে। সেই ভরসায় দু’হাত ভরে কো-অর্ডিনেশন কমিটিকে সমর্থন দিতেন কর্মচারীরা। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যেত, ব্যক্তিগত ভাবে কংগ্রেস বা অন্য দলের সমর্থক হলেও সরকারি কর্মচারী হিসাবে সকলেই কো-অর্ডিনেশন কমিটির পাশে পাশে থাকছেন। অন্য দিকে, সরকারও ‘ক্ষমতাবান’ কো-অর্ডিনেশন কমিটির দাবিদাওয়া মেনে নিত। ক্ষমতায় থাকার টানে কাজ না করে মিছিল, মিটিংয়েও ঢালাও ছাড়পত্র মিলত।
পরিস্থিতি কিছুটা বদলায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেই তিনি ‘ডু ইট নাউ’ স্লোগান তোলেন। সেই সময়ে অনেকে এ-ও বলেছিলেন যে, জ্যোতি বসুর আমলে সরকারি দফতরে কর্মসংস্কৃতি যে লাটে উঠেছে, সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। কর্মচারীদের আসা-যাওয়ার উপর অনেক বিধিনিষেধও আরোপ করা হয় সেই সময়ে। তাতে আপত্তিও তুলেছিলেন কো-অর্ডিনেশন কমিটির তৎকালীন নেতৃত্ব। সেই সময়ে কমিটি বুদ্ধদেব সরকারের অনেক নীতির সমালোচনাও শুরু করে। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় ধীরে ধীরে সরকারি কর্মচারীদের উপর থেকে কো-অর্ডিনেশন কমিটির রাশ শিথিল হতে থাকে। তত দিনে নির্বাচনের পদ্ধতিতেও অনেক বদল এসে গিয়েছে। লোকসভা বা বিধানসভা ভোটে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের নজরদারি অনেক কড়া হয়েছে। ফলে সরকারে টিকে থাকার জন্য সরকারি করণিকদের উপরে শাসকদলের নির্ভরতাও কমতে থাকে।
রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরে কো-অর্ডিনেশন কমিটির রাশ আরও আলগা হয়। প্রবীণ সরকারি কর্মচারীদের ব্যাখ্যা— কমিটির সমর্থন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীতি বা আদর্শগত জায়গা থেকে নয়। বরং চাকরিক্ষেত্রে সুখে ও স্বস্তিতে থাকার জন্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। কর্মচারী সংগঠনগুলিকে সরকারের তরফে গুরুত্ব দেওয়াই কমিয়ে দেন মমতা। ব্রিটিশ আমলের পুলিশের সংগঠনও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। তার বদলে তৈরি হয় ‘পুলিশ ওয়েলফেয়ার বোর্ড’। তার পরিচালনার দায়িত্ব পান সরকার মনোনীতরাই। সব মিলিয়ে সরকারি কর্মচারীদের গুরুত্বই কমে যায়।
এখন কর্মচারী সংগঠনের গুরুত্বই কমে গিয়েছে। সৌজন্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
পরিবেশগত ভাবেও কিছু বদল এনেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। মহাকরণে রাজ্যের প্রধান সচিবালয় থাকার সময় থেকেই কর্মচারী সংগঠনের দফতরগুলির গুরুত্ব কমিয়ে দেন। নবান্নে তো তার কোনও জায়গাই নেই! এমনকি, কর্মচারীদের ক্যান্টিনে বসে ‘গজল্লা’ করার সুযোগটাও নেই রাজ্যের বর্তমান প্রধান সচিবালয়ে। কারণ, ক্যান্টিনই নেই! একই ছবি জেলায় জেলায় সরকারি দফতরেও ছড়িয়ে যায়।
কো-অর্ডিনেশন কমিটি যে এখন নখদন্তহীন, তার প্রমাণ কয়েক মাস আগে ঘোষণা করা ‘নবান্ন ঘেরাও কর্মসূচি’ এখনও বাস্তবায়িত করতে না পারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে জলপাইগুড়িতে কো-অর্ডিনেশন কমিটির ২০তম রাজ্য সম্মেলন হয়েছিল। সেখানেই ঘোষণা করা হয়েছিল ‘নবান্ন ঘেরাও’ কর্মসূচি। তবে সেই ঘোষণার হোতা বিজয়শঙ্কর সিংহ সোমবার দাবি করেন, ‘‘আমরা মোটেও দুর্বল হইনি। নবান্ন ঘেরাও শুধু নয়, আরও বড় আন্দোলন হতে পারে। বন্ধ ডাকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।’’ একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘রাজ্য সরকার এখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছে। কর্মবিরতিতে যাওয়ার ঘোষণাতেই সরকার যে শাস্তির বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে, সেটাই তার প্রমাণ। এমন বিজ্ঞপ্তি জারি ধর্মঘট ডাকলে খাপ খায়। আমরা যে দিন ঘোষণা করেছি কর্মবিরতিতে যোগ দেব, তার পরের দিনই সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এটাই তো ভয় পাওয়ার বড় প্রমাণ।’’