বিস্ফোরণ-কাণ্ডে মুখে কুলুপ এসপি-র

নতুন ঘরের দরকার ছিল কি, প্রশ্নের মুখে প্রশাসন

কোনও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রর নিজস্ব ঘর নেই। আবার কোনও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রটি চলছে গাছের তলায় কিংবা স্থানীয় ক্লাবের বারান্দায়। প্রায়ই সংবাদপত্রে উঠে আসে রাজ্যের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির এমন বেহাল দশার কথা।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

খয়রাশোল শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৬ ০১:৫১
Share:

এই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের ‘বেহাল’ দশার কারণেই তৈরি হয়েছিল নয়া ঘর।

কোনও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রর নিজস্ব ঘর নেই। আবার কোনও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রটি চলছে গাছের তলায় কিংবা স্থানীয় ক্লাবের বারান্দায়। প্রায়ই সংবাদপত্রে উঠে আসে রাজ্যের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির এমন বেহাল দশার কথা।

Advertisement

ব্যতিক্রম নয় খয়রাশোল ব্লকও। ব্লকে এখনও পর্যন্ত নিজস্ব বাড়ি পায়নি ২৩টি অঙ্গনওয়াডি কেন্দ্র। কিন্তু, তৈরি হওয়ার এক বছর পরেও কেন লোকপুরের নওপাড়ার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রটি ব্যবহৃত হচ্ছিল না, সেই প্রশ্নই তুলে দিয়ে বুধবার গভীর রাতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে মাটিতে মিশে গিয়েছে আস্ত কেন্দ্রটিই।

কে বা কারা ওখানে বিস্ফোরক মজুত করেছিল, কী ধরনের বিস্ফোরক ছিল— তা পুলিশের তদন্ত সাপেক্ষ। কিন্তু, এই প্রশ্নটা সঙ্গত ভাবেই উঠছে, প্রশাসনের কোন পর্যায়ের গাফিলতি বা উদাসীনতায় লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে তৈরি হওয়া একটি নতুন কেন্দ্র কাজেই লাগানো গেল না? উল্টে, দুষ্কৃতীদের আখড়া হয়ে উঠল! এমনকী, এ প্রশ্নই উঠছে— আদৌ কি ওখানে কোনও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের প্রয়োজন ছিল?

Advertisement

খয়রাশোল ব্লক সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প আধিকারিক অনুপম বিশ্বাসের বক্তব্যে অন্তত তেমনই ইঙ্গিত। তিনি বলছেন, ‘‘ওই গ্রামের বর্তমান অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের আগে থেকেই নিজস্ব ঘর ছিল। কী প্রয়োজনে নতুন ঘর তৈরি হয়েছিল, তা আমাদের জানানো হয়নি। এমনকী, ঘরটি তৈরি হওয়ার পরেও সরকারি ভাবে তা আমাদের হস্তান্তরিত করা হয়নি।’’ অন্য দিকে, খয়রাশোলের বিডিও তারকনাথ চন্দ্রের দাবি, পুরনো অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের বর্তমান অবস্থা দেখেই এমএসডিপি বা সংখ্যালঘু উন্নয়ন খাতে প্রাপ্ত টাকায় নতুন করে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছিল। চাবিও হস্তান্তর করা হয়েছিল ওই কেন্দ্রের কর্মীর কাছে। তাতে সই রয়েছে সুপারভাইজারেরও। বিডিও-র বক্তব্য, ‘‘হস্তান্তরে পদ্ধতিগত বিচ্যুতি থাকলেও সিডিপিও জানেন না, এটা ঠিক নয়।’’

সরিয়ে ফেলা হয়েছে ধ্বংসস্তূপ।

দফতরের জেলা প্রকল্প আধিকারিক অরিন্দম ভাদুড়িও এই ‘পদ্ধতিগত বিচ্যুতি’র কথাই বলছেন। তাঁর কথায়, ‘‘শুক্রবার খয়রাশোল ব্লকের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরেছি। দেখলাম শুধু নওপাড়াই নয়, দফরতকে পদ্ধতিগত ভাবে না জানিয়ে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের ঘর তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে— সেই সংখ্যাটি ৮। সেগুলিও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কোথাও ঠিকাদার হয়তো কর্মীকে বলেছেন। কিন্তু কর্মী জানা মানে তো সিডিপিও জানলেন, তা তো নয়!’’ অরিন্দমবাবুর বক্তব্য, দফতরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তাঁরা প্রথমে যে ২৩টি কেন্দ্রের বাড়ি নেই, তাদেরই নাম পাঠাবেন। নওপাড়া সেই তালিকায় ছিল না বলেই তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।

এ দিকে, তারকনাথবাবুর দাবি, কখনও এমএসডিপি, কখনও পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ কখনও বা ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের টকায় অঙ্গওয়াড়ি কেন্দ্র বানানোর জন্য বারদ্দ করা হয়। ২০১৪ সালে সংখ্যালঘু উন্নয়ন তহবিল থেকে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র গড়তে বলা হয়েছিল। বিডিও বলছেন, ‘‘এলাকাবাসী জানিয়েছিলেন, যে কেন্দ্রটি বর্তমানে নওয়াপাড়ায় রয়েছে তা ছোট ও ভগ্নপ্রায়। যেটুকু সময় হাতে ছিল তাতে সুসংহত শিশু বিকাশ দফতরের কাছে রিপোর্ট চেয়ে কাজ করাতে গেলে টাকা ফেরত যেত। তা ছাড়া বর্তমান সিডিপিও-কে অধিকাংশ দিন অফিসেই পাওয়া যায় না। তাই হয়তো পদ্ধতি গত সব ধাপ মানা যায়নি।’’ ব্লক প্রশাসনের কর্তাদের একাংশও আড়ালে মানছেন, টাকা বরাদ্দ করার পরে সেই টাকা খরচ করে ইউসি দেওয়ার জন্য যে চাপ থাকে— তাতে এমন ত্রুটি থাকতেই পারে।

যাঁর নতুন কেন্দ্র গড়ে দেওয়া নিয়ে এত কাণ্ড, বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কেন্দ্রটি থেকে দুশো মিটার দূরে নওপাড়া অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মী আফরোজা বেগম বলছেন, ‘‘মোটেই আমার কেন্দ্রের অবস্থা খারাপ নয়। নতুন কেন্দ্রটি তৈরি হওয়ার পরে ঠিকাদার আমাকে চাবি দিয়ে সই করিয়ে নিলেও ওখানে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন হয়নি। মা-শিশুরাও যেতে চাননি।’’ তা হলে চাবি নিলেন কেন? আফরোজা বলছেন, ‘‘আমার ভাইপো ঠিকাদার। সে চাবি ধরিয়ে সই করতে বলেছিল, করেছিলাম। সুপারভাইজার দিদিকেও জানিয়েছিলাম।’’ কে ঠিক, কে ভুল— কোথায় সমস্যা? সেটাই খতিয়ে দেখতে শুক্রবার খয়রাশোলে এসেছিলেন অতিরিক্ত জেলাশাসক উমাশঙ্কর এস। কোথায় কোথায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র তৈরি হয়েও ব্যবহৃত হচ্ছে না, তা নিয়ে ব্লক প্রশাসনের কাছে একটি রিপোর্টও চেয়েছেন তিনি।

অন্য দিকে, বিস্ফোরণের পর ৪০ ঘণ্টা কেটে গেলেও এক জনকেও পুলিশ ধরতে পারেনি। ঠিক কী ধরনের বিস্ফোরক মজুত ছিল, কে বা কারা তা রেখেছিল, তা নিয়ে তদন্ত কোন পর্যায়ে— একটিও শব্দ খরচ করেননি পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা। যথারীতি ফোন ধরেননি পুলিশ সুপার। যদিও ধংসস্তুপে পরিণত হয়ে যাওয়া অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের অবশেষ তৎপরতার সঙ্গে সরিয়ে ফেলেছে প্রশাসন। প্রশাসনের একাধিক কর্তা ও আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ বলছেন, ‘‘একটি সরকারি ঘর ভাঙল বলে হইচই হচ্ছে। কিন্তু এলাকায় ঘরে ঘরে এত অস্ত্র মজুত রয়েছে, তা উদ্ধারের জন্য কেউ তো কিছু বলছে না। তৎপরতাও দেখাচ্ছে না কেউ।’’

—নিজস্ব চিত্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement