ধুবুলিয়ায় বাহাদুরপুর জঙ্গলের ধারে বোর্ড জানাচ্ছে, এখান দিয়েই গিয়েছে কর্কটক্রান্তি রেখা। ছবি: প্রণব দেবনাথ।
একের পর এক রেকর্ড-ভাঙা গরমে নাভিশ্বাস উঠেছে গোটাা দক্ষিণবঙ্গের। নদিয়ারও। আর সেই সঙ্গেই উসকে উঠেছে একটি প্রশ্ন: জেলার মাঝখান দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা যাওয়াতেই কি বেশি অসহনীয় হয়ে উঠেছে নদিয়ার পরিস্থিতি?
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেশে ঠিক সদর শহর কৃষ্ণনগর না হলেও তার একেবারে কাছ দিয়ে চলে গিয়েছে কর্কটক্রান্তি রেখা। জলঙ্গি পেরিয়ে ধুবুলিয়ার আগে বাহাদুরপুরের জঙ্গলের উপর দিয়ে গিয়ে সেটি যেখান দিয়ে ১২ নম্বর জাতীয় সড়ক অতিক্রম করছে, সেখানে বোর্ডে তা জানানও দেওয়া রয়েছে। সূর্য যত উত্তর-মুখে কর্কটক্রান্তি রেখার দিকে এগোয় ততই তার রশ্মি ওই রেখা-সংলগ্ন এলাকায় সরাসরি লম্বভাবে এসে পড়ে এবং ততই বাড়ে দহনের মাত্রা।
আপাতত সপ্তাহখানেক হতে চলল নদিয়ার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির নীচে নামছে না। তবে মঙ্গলবারের উত্তাপ যেন সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছে। কৃষ্ণনগরের তাপমাত্রা ছুঁয়েছে ৪৪ ডিগ্রি। অনেকেই তার জন্য এই কর্কটক্রান্তিকে দায়ী করছেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই?
বস্তুত শুধু নদিয়া নয়, পুরুলিয়া দিয়ে রাজ্যে ঢুকে বাঁকুড়া ও বর্ধমান হয়ে নদিয়ার ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে চলে গিয়েছে কর্কটক্রান্তি রেখা। উত্তরায়নে চলতে থাকা সূর্য এই রেখার উপর এসে পৌঁছবে আগামী ২১ জুন, কর্কট সংক্রান্তিতে। তার পর ফের সূর্যের দক্ষিণ দিকে চলা অর্থাৎ দক্ষিণায়ন শুরু। সেই কারণেই এপ্রিল পেরিয়ে মে যত গড়াবে, মধ্য-নদিয়ার পারদও ক্রমশ চড়তে থাকার কথা। কিন্তু সাধারণত জুনের গোড়া থেকেই যেহেতু প্রাক্-বর্ষার মেঘের আনাগোনা এবং অল্পস্বল্প বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়, সূর্য এগোলেও তাপমাত্রা আর বাড়তে পারে না। বাদলমেঘই সূর্যের আঁচকে আড়াল করতে থাকে।
কিন্ত শুধু কর্কটক্রান্তির রেখার সান্নিধ্যই যদি তাপমাত্রা বাড়ার কারণ হত, তা হলে পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার তেতে ওঠা রুখা জমির সঙ্গে পাল্লা দিত গাঙ্গেয় অববাহিকার বর্ধমান-নদিয়া। আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, ভূপ্রাকৃতিক নানা কারণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। সেই কারণেই ছোটনাগপুর মালভূমি লাগোয়া পুরুলিয়া নদী-ঘেরা নদিয়ার চেয়ে অনেক বেশি তেতে ওঠে। আবার শুধু ভূপ্রকৃতিই নয়, নির্বিচার নগরায়নও লাগামছাড়া তাপমাত্রার আর একটা কারণ। যার ফল হয়তো ভোগ করতে হচ্ছে কলকাতা শহর বা শহরতলিকে।
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-আবহাওয়া বিভাগের অধ্যাপক মনোজকুমার নন্দের কথায়, “কর্কটক্রান্তি রেখা হল উত্তর দিকে সূর্যের সর্বশেষ অবস্থান। এখান থেকে ফের মকরক্রান্তি অভিমুখে যাত্রা করে সূর্য। তা যেহেতু নদিয়ার উপর দিয়ে গিয়েছে, তাই রোদের তীব্রতা নদিয়া জেলায় এখন ক্রমশ বাড়তে থাকার কথা। কিন্তু একটা জায়গা কতটা গরম হবে সেটা স্থানীয় অনেক মাপকাঠির উপর নির্ভর করে।” শান্তিপুর মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক পুষ্পেন্দু মজুমদারও বলছেন, “উত্তরে কর্কটক্রান্তি থেকে দক্ষিণে মকরক্রান্তি রেখা পর্যন্ত সূর্যের চলাচল। কিন্তু সেই প্রান্তিক অবস্থানের কাছে থাকাই তাপপ্রবাহ বা শৈত্যপ্রবাহের কারণ নয়। ২১ জুন সূর্য যখন কর্কটক্রান্তির মাথার উপর, তখন কিন্তু এতো উত্তাপ থাকে না।”
এমন গরম যে আগে পড়েনি, এমটাও নয়। ভারত সরকারের আবহাওয়া বিভাগ প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, নদিয়া তথা কৃষ্ণনগরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ১৯৫৮ সালের ২৬ মে— ৪৬.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৫৪ সালের ২৫ এপ্রিল তাপমাত্রা ছিল ৪৫ ডিগ্রি আর ১৯৬৬ সালের ১২ জুন ৪৫.২ ডিগ্রি। ফলে এখনই ‘সর্বোচ্চ’ তকমায় লাভ নেই। কর্কটক্রান্তির দিকে আরও কিছু রোদে-পোড়া পথচলা হয়তো বাকি।