Rajbanshi Vote

মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যুর চেয়েও বড় তাঁর ‘বর্মণ’ পদবি, দশ বছরের ইতিহাস বলছে উত্তরের ওঁরা বড় মূল্যবান

পুলিশের গুলিতে রাজবংশী যুবকের মৃত্যু। কালিয়াগঞ্জের মৃত্যুঞ্জয় বর্মণের মৃত্যুতে লাগাতার এমনটাই বলছে বিজেপি। তবে এ নতুন নয়। অতীতে শাসক তৃণমূলকেও সরব হতে দেখা গিয়েছে অনেকটা একই সুরে।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২৩ ১০:৪০
Share:

দশ বছরের ইতিহাস বলছে উত্তরের ওঁরা বড় মূল্যবান। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

মৃত্যুঞ্জয় বর্মণ। উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জ সংলগ্ন রাধিকাপুর পঞ্চায়েতের চাঁদগ্রামে মৃত্যু হয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ের। বিজেপির অভিযোগ, পুলিশের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। শাসক তৃণমূল সরাসরি তার প্রতিবাদ করেনি। আর বিজেপি ওই মৃত্যুকে ঘিরে আন্দোলনের তেজ বাড়াতে গত শুক্রবার ১২ ঘণ্টার উত্তরবঙ্গ বন্‌ধের ডাক দিয়েছিল। সেখানেই না থেমে এই ঘটনা নিয়ে আন্দোলন টেনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে গেরুয়া শিবিরের। কিন্তু কেন?

Advertisement

এই মৃত্যু নিয়ে যত না মৃত্যুঞ্জয়ের নাম উচ্চারিত হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে তাঁর পদবি এবং জাতিগত পরিচয় নিয়ে। বিজেপির কাছে বিষয়টি হল, ‘পুলিশের গুলিতে রাজবংশী যুবকের মৃত্যু’। ঠিক এমন দাবিই উঠেছিল গত বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিয়ে বুথ থেকে বার হওয়ার সময় গুলিতে নিহত আনন্দ বর্মণের ক্ষেত্রেও। সেই সময়েও ‘রাজবংশী যুবকের মৃত্যু’ বলেই সংজ্ঞায়িত হয়েছিল ওই ঘটনা। ‘বর্মণ’ পদবি নিয়ে কম ‘স্পর্শকাতর’ নয় শাসক তৃণমূলও। গত ডিসেম্বরেই কোচবিহারের দিনহাটায় ‘পাচারকারী’ সন্দেহে প্রেম বর্মণ নামে এক যুবকের মৃত্যু নিয়ে সরব হয়েছিল তৃণমূল। তখনও প্রেমের ‘রাজবংশী’ পরিচয়ই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল।

আসলে সব রাজনৈতিক দলের কাছেই রাজবংশীরা বড় মূল্যবান। ভোট ব্যাঙ্ক হিসাবে তাঁরা যেমন শক্তিশালী, তেমনই সিদ্ধান্ত ও সমর্থন বদলের বিষয়েও তাঁরা সমান সক্রিয়। সেটাই বলছে রাজ্যের গত এক দশকের ভোট ইতিহাস। দীর্ঘ সময় বামেদের সঙ্গে থাকা রাজবংশীরা ২০১১ সালে সে ভাবে পালাবদলের অংশীদার হয়ে তৃণমূলের পাশে চলে আসেননি। বদলের শুরু ২০১৩ সালে। ২০১৩ এবং ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সঙ্গেই ছিল রাজবংশী ভোট। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে আবার বদল। প্রায় সব ভোটই চলে যায় বিজেপির ঝুলিতে। ২০২১ সালে রাজ্য বিজেপি ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছতে না পারলেও ২৫ শতাংশের বেশি রাজবংশী সম্প্রদায়ের ভোট রয়েছে, এমন ৩০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২১টিতে জয় পায়। তৃণমূল জেতে ৯টিতে। যে সব আসনে ভোটারদের বড় অংশই রাজবংশী, তার সবক’টিই পায় গেরুয়া শিবির। তার ঠিক পাঁচ বছর আগে এই ৩০টির মধ্যে তৃণমূলের দখলে ছিল ১৯টি আসন। বাম-কংগ্রেস জোট জিতেছিল ১১টিতে। তারও আগের বিধানসভা নির্বাচনে অর্থাৎ ২০১১ সালে ‘পরিবর্তন’-এর ভোটে ৩০টির মধ্যে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট পেয়েছিল ৮টি আসন। বামেরা পায় ২০টি। নির্দল জিতেছিল ২টি আসনে। ২০১১ থেকে ২০২১ দশ বছরের ভোটের ফলাফলই বলে দিচ্ছে রাজবংশীদের সমর্থন বদলের ইতিহাস।

Advertisement

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

মূলত কোচবিহারকেই রাজবংশীদের জেলা বলা হয়। ওই জেলায় রাজবংশী ভোট প্রায় ৬২ শতাংশ। পাশের জলপাইগুড়িতে রাজবংশী ভোট প্রায় ৫০ শতাংশ। আলিপুরদুয়ারে ৩৮ শতাংশ ৷ উত্তর দিনাজপুরে ৫২ শতাংশ৷ দক্ষিণ দিনাজপুরে ৪৮ শতাংশ। এ ছাড়াও মালদহের একটা ব়ড় অংশে রয়েছে রাজবংশী ভোট। সেই জোরেই ‘গ্রেটার কোচবিহার অ্যাসোসিয়েশন’-এর নেতা অনন্ত রায়, বংশীবদন বর্মন বা কেএলও প্রধান জীবন সিংহের মুখে আলাদা রাজ্যের দাবি লেগে থাকে। বিজেপির কয়েক জন জনপ্রতিনিধিও বিভিন্ন সময়ে এই দাবি সামনে এনেছেন জোরালো ভাবে। আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনেও রাজবংশী ভোট কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে, তা কোচবিহারের গত দশ বছরের ফল বলে দেয়।

এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে উত্তরবঙ্গের হিসাবে কোচবিহার জেলাতেই সবচেয়ে বেশি আসনে তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল। জেলায় গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট ১,৯৬৬ আসনের মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় মেলে ৬৭১ আসনে। ২০১৩ সালে যেটা ছিল ১২৭ আসন। ২০১৩ সালেও ৫৬৪ আসনে জয়ী বামফ্রন্ট ২০১৮-তে নেমে যায় ১১ আসনে। আর বিজেপি ২৫ থেকে পৌঁছায় ১১৬ আসনে।

পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষেত্রেও একই রকম ছবি দেখা গিয়েছে। মোট ৩৩৬ আসনের মধ্যে ১০৫টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে তৃণমূল পায় মোট ৩৩০টি। পাঁচ বছর আগে যা ছিল ২৩৯। আর বামফ্রন্ট ১১৪ থেকে কমে হয়ে যায় ২। সেখানে বিজেপি শূন্য থেকে ১১-য় পৌঁছয়।

জেলা পরিষদের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে একচেটিয়া জয় পায় তৃণমূল। ৩৩টি আসনের মধ্যে ৩২টিতেই জয়। একটি আসনে নির্দল প্রার্থী জিতলেও পরে তিনি শাসক শিবিরে যোগ দেন। কিন্তু তার এক বছরের মধ্যে লোকসভা নির্বাচনে একেবারে উল্টো ফল দেখা গিয়েছিল। কোচবিহার লোকসভা আসনে বিজেপি প্রার্থী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক ৪৭.৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও একমাত্র সিতাই ছাড়া জেলার ছ’টি আসনেই জেতে বিজেপি। পরে উপনির্বাচনে নিশীথের ছেড়ে দেওয়া দিনহাটায় অবশ্য বিপুল ভোটে জেতেন তৃণমূলের উদয়ন গুহ।

এই ইতিহাসই বলে দিচ্ছে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজবংশী জমি ধরে রাখতে মরিয়া হবে বিজেপি। অন্য দিকে, রাজবংশী মন ফিরে পেতে চেষ্টার ত্রুটি রাখবে না তৃণমূলও। অতীতেও এমনটা দেখা গিয়েছে। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে কোচবিহারে প্রচারে আসার আগে অসম গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কারণ, তখন রাজবংশীদের ‘স্বঘোষিত’ মহারাজা অনন্ত রায়ের আস্তানা ছিল অসমের চিরাং জেলার সতিবরগাঁও গ্রামে। রাজাকে খুশি করে তবেই রাজবংশী প্রজাদের মন পেতে এসেছিলেন শাহ। ঘোষণা করেছিলেন, কেন্দ্রের তরফে রাজবংশীদের নেতা পঞ্চানন বর্মার মূর্তি তৈরি করা হবে ২৫০ কোটি টাকা খরচ করে। জানিয়েছিলেন, আধাসামরিক বাহিনীতে ‘নারায়ণী ব্যাটেলিয়ন’ তৈরি করা হবে। বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নাম রাজবংশী ‘বীর’ চিলা রায়ের নামে রাখা হয়েছে। তবে তার আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য পুলিশে নারায়ণী ব্যাটালিয়ান গড়ার ঘোষণা করেন।

কারণ, সকলে জানেন, উত্তরের ‘ওঁরা’ খুব গুরুত্বপূর্ণ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement