Civic Volunteers

আনিস খানের হত্যা থেকে আরজি কর-কাণ্ডে আঙুল ওঠা সিভিক ভলান্টিয়াররা কোন ‘জাদু’তে এত দাপুটে?

প্রথমে নাম ছিল ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার’। পরে ‘পুলিশ’ বাদ গিয়ে নাম হয় ‘সিভিক ভলান্টিয়ার’। কাজের পরিধিও আরও বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু তাতে দাপট কমেনি বলেই অভিযোগ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৪ ০৭:৫৯
Share:

কী ভাবে হয় সিভিক ভলান্টিয়ারদের চাকরি? গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

হাওড়ার আমতায় আনিস খান হত্যাকাণ্ডের সময়ে এক জন সিভিক ভলান্টিয়ারের নাম উঠে এসেছিল। সেই মামলায় হাই কোর্টে দাঁড়িয়ে ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ মন্তব্য করেছিলেন তৎকালীন অ্যাডভোকেট জেনারেল গোপাল মুখোপাধ্যায়। ‘ব্যক্তিগত অভিমত’ বলে বর্ণনা করলেও ২০২২ সালের মে মাসে গোপাল বলেছিলেন, ‘‘রাজ্য জুড়ে সিভিক নিয়োগ বন্ধ রাখা উচিত!’’

Advertisement

প্রসঙ্গত, বাম জমানায় পশ্চিমবঙ্গে সিভিক ভলান্টিয়ার ছিল না। এই বাহিনীর শুরু ২০১২ সালে। রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের পরে। প্রায় তখন থেকেই শুরু তাঁদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার।

তবে ২০০৮ সালে বাম আমলে কলকাতায় যান নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘গ্রিন পুলিশ’ নামে একটি বাহিনী তৈরি করেছিল পুরসভা। পরে গোটা রাজ্যে তা চালু করে সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের ওয়েবসাইট বলছে, পুলিশে পর্যাপ্ত কর্মী না থাকায় ২০১৩ সালে রাজ্যে ৪০,০০০ পুলিশ এবং ১,৩০,০০০ হাজার ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার’ নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই ওয়েবসাইটেই বলা রয়েছে, এই মুহূর্তে রাজ্যে এই বাহিনীতে ১ লাখ ২০ হাজারের মতো নিয়োগ হয়ে গিয়েছে। প্রথমে নাম ছিল ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার’। প্রধান বিরোধিতা এসেছিল পুলিশবাহিনীর তরফেই। এর পরেই ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাহিনীর নাম থেকে ‘পুলিশ’ শব্দটি ছেঁটে দেয় রাজ্য সরকার। করা হয় ‘সিভিক ভলান্টিয়ার’। সেই বদলের পরেও বিরোধীরা বারংবার এই বাহিনীকে শাসকদলের ‘উর্দি পরা ক্যাডার’ বলে উল্লেখ করেছেন।

Advertisement

রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেলের হাই কোর্টে ওই মন্তব্যের পরেও একের পর এক ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে নীল পোশাকের এই তথাকথিত স্বেচ্ছাসেবকদের বিরুদ্ধে। এ বার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক মহিলা চিকিৎসককে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া সিভিক ভলান্টিয়ারকে নিয়ে নানা অভিযোগ। অনেকে এমনও বলছেন যে, কোনও এক ‘প্রভাবশালী’র ছত্রছায়ায় থাকার জন্যই সিভিক ভলান্টিয়ার হয়েও ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করতেন তিনি।

অনেকেই মনে করেন, সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়োগের অন্যতম শর্ত হল শাসক তৃণমূলের প্রতি ‘আনুগত্য’। বিভিন্ন এলাকার তৃণমূল নেতারা তাঁদের পছন্দের এবং অনুগত লোকজনকে ওই চাকরি ‘পাইয়ে দেন’। তার ফলেই সিভিকদের ‘দাপট’ নিরবচ্ছিন্ন পর্যায়ে পৌঁছয়। ভুক্তভোগীরা অনেকেই এই সমস্ত সিভিকদের ‘শাকদলের হার্মাদবাহিনী’র সঙ্গেও তুলনা করে থাকেন।

নিত্যনৈমিত্তিক কাজেও সিভিক ভলান্টিয়ারদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। ‘তোলাবাজি’ থেকে নির্বাচনের সময়ে শাসকদলের হয়ে ‘শাসানি’ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার মধ্যে। যানবাহন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনেক সময়ে পুলিশের চেয়েও বেশি দাপট দেখান অনেক সিভিক ভলান্টিয়ার। ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়’ বলেও অভিযোগ ওঠে।

কিন্তু কী ভাবে সিভিক ভলান্টিয়াররা এত দাপুটে হয়ে উঠলেন? বিরোধীদের স্পষ্ট নিশানায় শাসকদল। বিজেপি নেতা তমোঘ্ন ঘোষ বলেন, ‘‘কেন দাপট হবে না সেটা বরং প্রশ্ন। সিভিক ভলান্টিয়ার কোনও না কোনও তৃণমূল নেতার সুপারিশেই তো নিযুক্ত হন। দাদার ভাই হিসাবেই তো কাজ করেন ওঁরা।’’ পাশাপাশি এমনটাও বলা হয় যে, ইদানীং পুলিশবাহিনীতে পর্যাপ্ত কর্মী না থাকাতেই সিভিক ভলান্টিয়ারদের উপরে ‘নির্ভরতা’ বাড়ছে। যে কাজের দায়িত্ব তাঁদের দেওয়ার কথা নয়, অনেক সময়ে তা করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। তাতেও বাড়ছে তাঁদের দাপট।

তবে এই অভিযোগ মানতে প্রত্যাশিত ভাবেই নারাজ শাসকদল। তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ শান্তনু সেনের বক্তব্য, ‘‘পুলিশের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম বেতনে কাজ করেও সিভিক ভলান্টিয়াররা সার্বিক ভাবে খুবই ভাল পরিষেবা দেন।’’ বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে শান্তনু বলেন, ‘‘কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনার সঙ্গে জুড়ে সকলের দিকে আঙুল তোলা ঠিক নয়। সব ক্ষেত্রেই নানা ধরনের মানুষ থাকেন। তাই দু’-এক জনের জন্য সকলকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। কারণ, সেটা মোটেই সার্বিক চিত্র নয়।’’

প্রসঙ্গত, শুধু বাংলা নয়, অনেক রাজ্যেই পুলিশবাহিনীর বাইরে ‘স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ রয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গোটা রাজ্যের না হয়ে সেটা বড় বড় শহরকে কেন্দ্র করে। বস্তুত, বাংলাদেশের ঢাকা শহরেও এমন নিরস্ত্র এবং যানবাহন নিয়ন্ত্রণকারী ‘আনসার বাহিনী’ রয়েছে। সাধারণ ভাবে ভারতের বিভিন্ন শহরে সিভিক ভলান্টিয়াদের মেলা বা বড় জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আবার বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে কাজের দায়িত্ব দেওয়ারও নজির রয়েছে। বাংলায়ও শুরুতে শুধু কলকাতা শহরের জন্যই ছিল এই বাহিনী।

প্রথমে যখন এই বাহিনী তৈরি হয়, তখন বলা হয়েছিল পুলিশের অপ্রতুলতার জন্য ‘সাহায্যকারী’ হিসেবে এই বাহিনীর সদস্যেরা কাজ করবেন। চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করবে স্বরাষ্ট্র দফতর। ছ’মাস অন্তর ওই চুক্তি পুনর্নবীকরণও হওয়ার কথা। এঁদের মূল কাজ কলকাতার বাইরে বিভিন্ন রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রণ ও মেলা-পার্বণে ভিড় সামলানো। সরকারি নির্দেশে এটাও বলা হয় যে, জেলা স্তরে কমিটি তৈরি করে ভলান্টিয়ার্স বাছাই করা হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক হলেই চলবে। কিন্তু পরে সেই নিয়ম বদলে যায়। এখন নতুন নিয়মে ২০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে যে কোনও বয়সিরাই সিভিক ভলান্টিয়ার পদের জন্য আবেদন করতে পারেন। সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে অষ্টম শ্রেণি পাশ। বেতন মাসে ৯ হাজার টাকা। যে থানার অধীনে নিয়োগ হবে, সাধারণ ভাবে সংশ্লিষ্ট সিভিক ভলান্টিয়ারকে সেখানকারই বাসিন্দা হতে হয়। তবে কাছাকাছি বাড়ি হলে সমস্যা হয় না। অস্থায়ী সরকারি কর্মী হিসাবে এই নিয়োগের গোটা প্রক্রিয়া— আবেদন থেকে নিয়োগ সবটাই হয় অফলাইনে।

এই নিয়োগ পদ্ধতিতেই ত্রুটি রয়েছে বলে মনে করেন বিরোধীরা। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে বাঁকুড়া পুলিশের উদ্যোগে প্রাথমিকের পড়ুয়াদের পাঠ দেওয়ার কাজে সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সেই সময়ে আদালতেও পৌঁছে গিয়েছিল সিভিক ভলান্টিয়ারদের কাজ নিয়ে বিতর্ক। তবে এই কাজ যাঁরা করেন, এখন তাঁরা ভাল কাজ করলে পুরস্কৃত হওয়ার সুযোগও রয়েছে। কারণ, ২০২৩ সালেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভাল কাজ করলে পুরস্কৃত করার ঘোষণা করেন। প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়ে বৈঠকে কোনও সিভিক ভলান্টিয়ার ভাল কাজ করলে তাঁকে স্থায়ী চাকরি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়েও আধিকারিকদের ভাবতে বলেন। সেই সময়ে এটাও জানিয়েছিলেন যে, সুযোগ তাঁরাই পাবেন যাঁদের নাম ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সুপারিশ করবেন। এই দায়িত্ব মূলত থাকবে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের উপরে। তিনি আবার সুপারিশের জন্য নির্ভর করবেন যে থানা এলাকায় ওই সিভিক ভলান্টিয়ার কাজ করছেন, সেখানকার ওসি এবং এসডিপিও-র রিপোর্টের উপরে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement