অস্থি-শল্য চিকিৎসক শ্যামাপদ দাশ। —ফাইল ছবি।
‘‘অনেক হয়েছে। আর আমি কোনও কিছুর মধ্যে থাকতে চাই না।” বলছেন অস্থি-শল্য চিকিৎসক শ্যামাপদ দাশ।
কে তিনি? যে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’কে কেন্দ্র করে এই মুহূর্তে রাজ্যের চিকিৎসক মহল উত্তাল, শ্যামাপদ সেই গোষ্ঠীর ‘জনক’ বলেই পরিচিত।
গত কয়েক বছর ধরে রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠছে বিশেষ ক্ষমতাবান গোষ্ঠী ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র বিরুদ্ধে। যাদের ‘দাসত্ব’ মেনে না নিলে বদলির খাঁড়া নেমে আসাই অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। পদোন্নতি থেকে পরীক্ষায় পাশ করা সবই নাকি চলে এই গোষ্ঠীর অঙ্গুলিহেলনে। সেখানে বিভিন্ন স্তরের নেতা থাকলেও, ‘এস পি দাশ’-ই ‘আসল মাথা’ বলে অভিযোগ চিকিৎসক মহলের বড় অংশের। তাঁদের প্রশ্ন, যিনি নিজে কখনও সরকারি চাকরি করেননি, সরকারি কোনও পদেও থাকেননি, শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর চিকিৎসা করেন, এই পরিচিতি ভাঙিয়ে তিনি রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘অলিখিত অভিভাবক’ হয়ে উঠলেন? মুখ্যমন্ত্রীর চিকিৎসা তো বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে অনেকেই করেছেন।
শ্যামাপদ অবশ্য নিজেকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘নিয়ন্ত্রক’ বলে মানতে নারাজ। দাবি করলেন, “আমি তো নবান্ন বা স্বাস্থ্য ভবনে বসি না। তা হলে নিয়ন্ত্রণ করব কী ভাবে? আমি নিজের প্র্যাকটিস নিয়ে ব্যস্ত থাকি।” তা হলে পদোন্নতি থেকে বদলি সব কিছুতেই আপনার নাম জড়ায় কেন? শ্যামাপদের দাবি, “মুখ্যমন্ত্রীর চিকিৎসক বলে হয়তো অনেক সময় কারও কোনও অনুরোধ থাকলে, সেটা জানাতাম। কিন্তু সব কিছু তো আমি করতে পারি না।” যদিও চিকিৎসক মহলের বড় অংশের অভিযোগ, রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আকাশে ‘মেঘনাদ’ হয়ে রয়েছেন শ্যামাপদ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিকিৎসা কবে প্রথম করেন? শ্যামাপদের জবাব, ‘‘১৯৮১ সালে জেনারেল প্র্যাকটিশনার হিসেবে কালীঘাটের ওষুধের দোকানে চেম্বারে বসতাম। মমতা তখন ছাত্রনেত্রী। গোড়ালি মচকে যাওয়ায় আমার কাছে এসেছিলেন। তার পর থেকে পরিবারের যার যা ঘটত, আমার ডাক পড়ত। ১৯৯০ সালে অস্থি-শল্য চিকিৎসক হই। ওঁর বিভিন্ন চোট-আঘাতে চিকিৎসা করেছি। এখনও করি।’’
শ্যামাপদ এমবিবিএস পাশ করেছিলেন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ থেকে। অভিযোগ, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে তাঁর বাড়বাড়ন্ত শুরু এবং স্বাস্থ্যে রীতিমতো সিন্ডিকেট তৈরি হয় তাঁরই নেতৃত্বে। গোড়ায় ওই কলেজ থেকে পাশ করা কয়েক জন সতীর্থ তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সেই থেকে ওই গোষ্ঠীর নাম হয় ‘উত্তরবঙ্গ লবি’। কোভিডের সময় থেকে তাঁদের প্রভাব বাড়তে থাকে। পরে অবশ্য রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা বেশ কয়েক জন চিকিৎসক তাঁর অনুগামী তালিকায় নাম লেখান। অভিযোগ, নেপথ্যে থেকে তাঁদের দিয়েই সব কাজ করাতেন শ্যামাপদ।
আর জি কর হাসপাতালের ঘটনার পরে সন্দীপ ঘোষের পদত্যাগের চার ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে পুনর্বহালের নেপথ্যেও ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র প্রভাব কাজ করেছে বলেই অভিযোগ। এবং সেখানেও শ্যামাপদের হাতই দেখছে চিকিৎসক মহল। আপনি সন্দীপের পদত্যাগ আটকে, পুনর্বহাল করিয়েছেন? শ্যামাপদ বললেন, “আমরা দু’জনেই অস্থি-শল্য চিকিৎসক। একই সংগঠনের সদস্য। এর বাইরে কোনও পরিচয় নেই।”
সূত্রের খবর, ‘উত্তরবঙ্গ লবির’ ‘মেজকর্তা’ চক্ষু চিকিৎসক সুশান্ত রায় ও দাপুটে নেতা অভীক দে ছিলেন শ্যামাপদের সঙ্গে সন্দীপের যোগাযোগের মাধ্যম। সম্প্রতি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও অভিযোগ করেছেন, “সন্দীপ ঘোষ, সুদীপ্ত রায়, অভীক দে, বিরূপাক্ষ বিশ্বাস, সুশান্ত রায়— এই চক্র এস পি দাশের আশীর্বাদে কাজ করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর সাহায্যে ও অনুপ্রেরণায় এস পি দাশ এই কাজগুলো করেছেন।” তা শুনে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে শ্যামাপদ বললেন, “উনি কী বলেছেন জানি না। তবে, এক জন পেশাদার চিকিৎসক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর চিকিৎসা করা নিশ্চয় আমার অন্যায় নয়।” যদিও চিকিৎসক মহলের একাংশের দাবি, ‘এই সিন্ডিকেটের সকলেই সকলকে চেনেন। এখন সিবিআই, ইডির ভয়ে পিছু হটছেন।’
চিকিৎসক মহলের এ-ও অভিযোগ, শ্যামাপদের ‘মুখ্যমন্ত্রীর চিকিৎসক’ হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সর্বত্র শীর্ষ পদে বসানো হয়েছে লবি-ঘনিষ্ঠদের। শ্যামাপদ বলেন, “কে আমার নাম নিয়ে কোথায় কী করছেন, সব জানা সম্ভব নয়।”
কিন্তু সুশান্ত, সুদীপ্ত, অভীক, বিরূপাক্ষদের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগাযোগই ছিল না? শ্যামাপদ জানাচ্ছেন, তিনি সুদীপ্ত রায়কে চেনেন। সুশান্তর সঙ্গে পরিচয় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী হিসেবে। তিনি বলেন, “সুশান্ত প্রাক্তনীদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ওঁর মাধ্যমেই অভীকের সঙ্গে পরিচয়।” আর বিরূপাক্ষকে তিনি চোখেই দেখেননি, কথা হয়নি বলেও দাবি। তা হলে, সমস্ত ঘটনার নেপথ্যে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল যখন উঠছে, সেখানে তাঁর নাম শীর্ষে আসছে কেন? শ্যামাপদ বলেন, “আরও অনেকেই আমার নাম ভাঙিয়ে অনেক কিছু করতেন। পরে শুনতাম। কিন্তু তাঁদের অনেককে আমি চিনিই না। তাই বিশ্বাস করতাম না।”
কিন্তু অভীক-বাহিনীর বিরুদ্ধে তো এত অভিযোগ? শ্যামাপদের কথায়, “যখন এত অভিযোগ উঠছে, তখন নিশ্চয় কিছু করেছেন। হয়তো এমন কিছু ঘটনা ঘটিয়েছেন, যা করা উচিত হয়নি।” তা হলে তিনি প্রকান্তরে মানছেন, তাঁর নাম ব্যবহার করে অনৈতিক কাজও করা হয়েছে? শ্যামাপদ বলেন, “কোনও অনৈতিক কাজ করিনি, কাউকে করতেও বলিনি। এ বার ঠিক করে ফেলেছি, প্র্যাকটিস ছাড়া আর কোনও বিষয়ে থাকব না। কারণ, আমার পারিবারিক সম্মানহানি হচ্ছে়।” এ বার থেকে ‘কোনও বিষয়ে’ থাকবেন না, তা হলে এত দিন যে ছিলেন, মানছেন? শ্যামাপদের জবাব, “সব চক্রান্ত। মুখে কুলুপ আঁটছি। আর কোনও কথাই বলতে চাই না।”