তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। — ফাইল চিত্র।
তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে ‘অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন’ নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে লোকসভার এথিক্স কমিটি প্রথমে দুই অভিযোগকারী এবং পরে মহুয়ার কথা শুনেছে। যদিও কমিটির বৈঠক থেকে মাঝপথে বেরিয়ে এসেছিলেন মহুয়া-সহ বিরোধী পক্ষের সাংসদেরা। তৃণমূল সাংসদের অভিযোগ ছিল, তাঁকে ‘ব্যক্তিগত এবং অপমানজনক’ প্রশ্ন করেছেন কমিটির চেয়ারম্যান তথা বিজেপির সাংসদ বিনোদ সোনকর।
গত ২৬ অক্টোবর অভিযোগকারী বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে এবং মহুয়ার প্রাক্তন বান্ধব জয় অনন্ত দেহাদ্রাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এথিক্স কমিটি। বৃহস্পতিবার কমিটি ডেকেছিল কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়াকে। এটা স্পষ্ট নয় যে, দুটি শুনানির পরেই কমিটির চেয়ারম্যান লোকসভার স্পিকার কথা লোকসভাকে তাঁর বক্তব্য জানাবেন কিনা। কিন্তু কমিটির চেয়ারম্যান যদি মহুয়াকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করে স্পিকারের কাছে তাঁর শাস্তি সুপারিশ করেন, তা হলে কী সাজা হতে পারে তৃণমূল সাংসদের?
কিন্তু মহুয়ার শাস্তি হলে তাঁর কী শাস্তি হতে পারে?
কেউই বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত নন। কিন্তু অতীতের নজির ঘেঁটে বিভিন্ন জল্পনা শুরু হয়েছে। ভারতীয় সংসদে এথিক্স কমিটির ইতিহাস খুব প্রাচীন নয়। ১৯৯৬ সাল নাগাদ এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। প্রথমে আলোচনা হয় রাজ্যসভায়। ১৯৯৭ সালের ৪ মার্চ তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান কে আর নারায়ণন এথিক্স কমিটি গঠন করেন। এর পরে ২০০০ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে তৎকালীন লোকসভার স্পিকার জিএমসি বালযোগী একটি ‘অস্থায়ী’ এথিক্স কমিটি গঠন করেন। স্থায়ী এথিক্স কমিটি হয় ২০১৫ সালে।
এই ধরনের কমিটি প্রথম আলোচনায় আসে ২০০৫ সালে। সে বার ঘুষের বিনিমিয়ে প্রশ্নের অভিযোগ ওঠায় সংসদের ওই কমিটি ১১ জন সাংসদকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। ১০ জন লোকসভার সাংসদ এবং এক জন রাজ্যসভার সাংসদ। সকলেরই সাংসদ পদ খারিজ হয়ে যায়।
মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, দুবাইকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী দর্শন হীরানন্দানির থেকে তৃণমূল সাংসদ অর্থ এবং উপহার নিয়ে লোকসভায় প্রশ্ন তুলেছেন। বিষয়টি লিখিত ভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন হীরানন্দানি। ওই ব্যবসায়ীকে তাঁর লগ ইন আইডি এবং পাসওয়ার্ড দিয়েছিলেন বলে মেনে নিয়েছেন মহুয়াও। তবে ২০০৫ সালে ১১ জন সাংসদকে একটি সংবাদমাধ্যমের গোপন ক্যামেরা অভিযানে হাতে করে টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম ২০০৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সেই সব ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এনেছিল। তাতে দেখা গিয়েছিল, সংসদে প্রশ্ন করার জন্য তাঁরা নগদ অর্থ নিচ্ছেন।
তবে মহুয়ার ক্ষেত্রে ‘অর্থ নিয়ে প্রশ্ন’ ছাড়াও একটি অভিযোগ রয়েছে। হীরানন্দানিকে তাঁর সাংসদের লগ ইন আইডি এবং পাসওয়ার্ড দেওয়ার অভিযোগ। যা নিয়মবিরুদ্ধ। এমন অভিযোগও উঠেছে যে, মহুয়া ভারতে থাকলেও বিদেশ থেকে মোট ৪৭ বার ওই আইডি এবং পাসওয়ার্ড দিয়ে লগ ইন করা হয়েছে। এমন নজির অতীতে নেই। ২০০৫ সালে লগ ইন ব্যবস্থা ছিল না। তবে অতীত নজির বলছে, অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন করার জন্য মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজের সুপারিশ করার ক্ষমতা রয়েছে কমিটির।
২০০৫ সালে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁদের ছ’জন বিজেপি সাংসদ এবং তিন জন ছিলেন মায়াবতীর দল বিএসপির। এ ছাড়াও ছিলেন কংগ্রেসের এক জন এবং লালুপ্রসাদ যাদবের দল আরজেডির এক সাংসদ। অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই লোকসভার তৎকালীন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় একটি তদন্ত কমিটি তৈরি করেছিলেন। কমিটির শীর্ষে ছিলেন কংগ্রেস সাংসদ পবনকুমার বনসল। কমিটি রিপোর্ট দেওয়ার পরে পরেই লোকসভায় বিষয়টির উত্থাপন করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনিই তখন সংসদের নিম্নকক্ষে কংগ্রেসের দলনেতা। একই প্রস্তাব রাজ্যসভায় আনেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। ঘটনা প্রকাশ্যে আসার ১০ দিনের মাথায় লোকসভা ও রাজ্যসভায় ভোটাভুটির মাধ্যমে ১১ সাংসদই বহিষ্কৃত হন।
এ বারেও অভিযোগ ওঠার পরেই বিষয়টি এথিক্স কমিটিতে পাঠান স্পিকার ওম বিড়লা। অতীত নজির বলছে, কমিটি মহুয়াকে ‘দোষী’ বলে সাব্যস্ত করলে তা জানাবে স্পিকারকে। ভোটাভুটির মাধ্যমে এর পরে লোকসভায় ঠিক হবে মহুয়ার ভবিষ্যৎ। ডিসেম্বরের গোড়াতেই লোকসভায় শীতকালীন অধিবেশন বসবে। সেখানেই মহুয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই বিজেপি এবং শরিক দলের সাংসদেরা মহুয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিলে সে দিন থেকেই আর সাংসদ থাকতে পারবেন না মহুয়া। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত তৃণমূলের সাংসদ সংখ্যা ২৩ থেকে কমে ২২ হয়ে যাবে। সামনেই লোকসভা নির্বাচন থাকায় কৃষ্ণনগরে উপনির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে।
সম্ভাবনা কম হলেও অনেকে বলছেন, এথিক্স কমিটি এমন সুপারিশও করতে পারে যে, বর্তমান লোকসভার আগামী দু’টি অধিবেশনের জন্য সাসপেন্ড থাকুন মহুয়া। বা এই সুপারিশও করতে পারে যে, লোকসভায় থাকলেও কোনও প্রশ্ন করতে পারবেন না মহুয়া। তবে বিজেপি মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে যে ভাবে সরব, তাতে এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান বরখাস্তের সুপারিশই করতে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন।
বিজেপি নেতারা অনেকেই বলছেন, তাঁরা মহুয়াকে জেলে দেখতে চান! তার কি সম্ভব? ২০০৫ সালের নজির অন্তত তা বলছে না। প্রথমত, কমিটির সুপারিশ কার্যকর করে সংসদ কারও সাংসদ পদ কেড়ে নিতে পারে। কিন্তু ফৌজদারি সাজা শোনাতে পারে না।
কিন্তু আলাদা করে মামলা হলে? ২০০৫ সালে তা হয়েছিল। বরখাস্ত সাংসদদের বিরুদ্ধে এফআইআরের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লি হাই কোর্টে চার্জশিটও জমা পড়ে। বরখাস্ত ১১ সাংসদই সুপ্রিম কোর্টে যান। শীর্ষ আদালতে প্রশ্ন উঠেছিল, আদালত কি আদৌ সংসদীয় প্রক্রিয়ার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে? সে প্রশ্নের ‘সদুত্তর’ না মেলায় রায় ঘোষণা স্থগিত রাখে সুপ্রিম কোর্ট। ফলে এখন মহুয়ার বিরুদ্ধে কোনও ফৌজদারি অভিযোগ উঠলেও তা আদালতে ‘গ্রহণযোগ্য’ হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সিবিআইয়ের কাছে যে অভিযোগ করা হয়েছে, সেটি নিয়েও জল্পনা চলছে। কারণ, তদন্ত যে স্তরেই হোক, বিচারের জন্য আদালতে যেতেই হবে। আদালত সংসদের ভিতরের বিষয় শুনবে কি না, সে প্রশ্ন রয়েছে সুপ্রিম কোর্টেরই।
এর পরেও দু’টি প্রশ্ন উঠছে? এক, সাংসদ পদ চলে গেলেও মহুয়া কি সেই বাবদে পেনশন পাবেন? অতীত নজির এবং নিয়ম বলছে, কেউ এক দিনের জন্য সাংসদ থাকলেই সম্পূর্ণ পেনশন পাওয়ার অধিকারী। দ্বিতীয় প্রশ্ন, মহুয়া কি আগামী দিনে কোনও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন? ভারতে কোনও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য কোনও অভিযোগ ‘বাধা’ নয়। এমনকি, কোনও অভিযোগে সাংসদ বা বিধায়ক পদ খারিজ হয়ে গেলেও নয়। একমাত্র কোনও আদালত যদি কমপক্ষে দু’বছরের জন্য সাজা ঘোষণা করে, তবেই তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না।