মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
রাজ্যে পুলিশকর্মী দরকার। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া ‘সময়সাপেক্ষ’। সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে পুলিশের প্রশিক্ষণ পর্বের মধ্যেই কাজে যোগ দেওয়ার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্র ও পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, ‘‘পুলিশে রিক্রুটমেন্ট (নিয়োগ) করতে একটু টাইম লাগে। কিন্তু আমি বলেছি বেশি টাইম না নিয়ে নিয়োগ করতে।’’ তার পরেই মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র ডাক্তারদের শিক্ষা এবং হাতেকলমে কাজ একই সঙ্গে করার উদাহরণ দিয়ে বলেন, পুলিশও প্রশিক্ষণের সময়েই কাজ করবে। তাঁর কথায়, ‘‘তিন মাস, ছ’মাস প্রশিক্ষণ দেওয়ার দরকার নেই। কারণ, আমার অত ম্যান পাওয়ার নেই। আমাদের ম্যান পাওয়ার সব জায়গায় দিতে হয়।’’ অর্থাৎ, পুলিশবাহিনীতে লোক কম। কারণ, বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন জায়গায় কাজে লাগাতে হয়।
মুখ্যমন্ত্রীর ওই বক্তব্য নিয়ে পুলিশ এবং প্রশাসনিক মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেরই আশঙ্কা, কম সময়ের প্রশিক্ষণ চালু হলে পুলিশকে আরও অভিযোগ শুনতে হবে। অনেক পুলিশ অফিসারের অভিমত, কম সময় ধরে প্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়ে কাজ করা সমস্যার হতে পারে। প্রাক্তন পুলিশকর্তাদের কেউ কেউ সরাসরি ওই নীতির বিরোধিতাও করেছেন। তাঁদের দাবি, এমনিতেই পুলিশ বিভিন্ন কারণে সমালোচিত হয়। প্রশিক্ষণের সময় কম হলে তার সম্ভাবনা আরও বাড়বে।
পুলিশকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে গোটা দেশেই। কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের নিয়মও মোটামুটি একই। কনস্টেবল থেকে সাব ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হওয়ার পরে ছ’মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সেই প্রশিক্ষণে যেমন খাতা-কলম নিয়ে ক্লাস করতে হয়, তেমনই শারীরিক প্রশিক্ষণও হয়। কলকাতা পুলিশের প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা সংস্থা রয়েছে হাওড়ায়। নাম ‘কলকাতা পুলিশ ট্রেনিং অ্যাকাডেমি’। রাজ্য পুলিশের জন্য ব্যারাকপুরে রয়েছে ‘স্বামী বিবেকানন্দ স্টেট পুলিশ অ্যাকাডেমি’। সেখানে কলকাতা পুলিশেরও প্রশিক্ষণ হয়।
নিয়ম অনুযায়ী চালক এবং কনস্টেবলদের ছ’মাসের প্রশিক্ষণ হয়। সাব ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ হলে এক বছরের প্রশিক্ষণ হয়। সেই পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয় আইনকানুন শিক্ষায়। কী ভাবে কোনও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরি করতে হবে বা তদন্তে গিয়ে কী কী নিয়ম মানতে হবে, সে সবেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পুলিশ প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত এক অফিসারের কথায়, ‘‘পুলিশকে আইনের রক্ষক বলা হয়। তাঁকে আইন সম্পর্কে জানতেই হবে। তিনি নিজে যেমন আইন ভাঙবেন না, তেমনই অন্যকে আইন ভাঙতে দেবেন না।’’
সাধারণ মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করার পুলিশ প্রশিক্ষণে নিজেদের সুরক্ষিত রাখাও শেখানো হয়। কোনও ভিড় সামলাতে কী করণীয় বা কী করা চলবে না যেমন শেখানো হয়, তেমনই কোন পরিস্থিতিতে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে হবে বা প্রয়োজনে গুলি চালাতে হবে, তা-ও শিখতে হয়। প্রস্তুতি নিতে হয় জলকামানের ব্যবহার সম্পর্কেও। দেওয়াল বেয়ে ওঠা থেকে সাম্প্রতিক সময়ের সাইবার অপরাধের মোকাবিলাও রয়েছে পুলিশ প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রমে। প্রসঙ্গত, পুলিশের প্রশিক্ষণের যে ব্যবস্থা রয়েছে, তাতেও হাতেকলমে শিক্ষা নিতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম শেষ হওয়ার পরে কোনও থানায় গিয়ে এক বছর শিক্ষানবিশ থাকতে হয়। বেতন-সহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা এক হলেও দ্বিতীয় বছরের প্রশিক্ষণ ‘বাধ্যতামূলক’।
প্রাথমিক প্রশিক্ষণে সময় কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তাঁর যুক্তি: হাতেকলমে কাজ করতে করতেই পুলিশবাহিনীর নতুন সদস্যদের শেখা হয়ে যাবে। পুলিশের মধ্যে প্রশিক্ষণের সময় কমানো মিশ্র মতামত রয়েছে। কলকাতা পুলিশের এক অফিসারের বক্তব্য, ‘‘আমরা যে কঠিন প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম, সেটা যে জরুরি, তা এখন কাজ করার সময়ে প্রতি পদে বুঝতে পারি। যাঁরা কম সময় প্রশিক্ষণ নেবেন, তাঁদের নিজেদেরই কাজ করতে সমস্যা হতে পারে। তাঁদের নিয়ে যাঁরা কাজ করবেন তাঁদেরও সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।’’ আবার রাজ্য পুলিশের ডিএসপি পদমর্যাদার এক অফিসারের বক্তব্য, ‘‘প্রশিক্ষণ যে জরুরি সেটা ঠিক। কিন্তু কাজ করতে করতেই আসল শিক্ষা হয়। আমরাও অনেক কিছুই কাজ করতে করতে শিখেছি, যেগুলো প্রশিক্ষণের সিলেবাসে ছিল না।’’
রাজ্যের প্রাক্তন ডিজি (রেল) অধীর শর্মা আবার প্রশিক্ষণের সময় কমিয়ে দেওয়ার বিপক্ষে। তাঁর কথায়, ‘‘এর ফলে পুলিশের সমস্যা হবে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘গোটা দেশে সাজা ঘোষণার হার যেখানে ৪০ শতাংশ, সেখানে বাংলায় সেই হার ১৪ শতাংশের মতো। প্রশিক্ষণের সময় কমিয়ে দিলে সেই হার আরও কমতে পারে। কারণ, গ্রেফতার করা বা চার্জশিট পেশ করাতেই পুলিশের কাজ শেষ হয়ে যায় না।’’