Sutapa Chowdhury Murder Case

কী ঘটেছিল সে দিন? সুতপাকে হত্যা করার সময় আশপাশের লোকজনকে ভয় দেখাতে কী করেছিলেন সুশান্ত?

সুতপাকে এক ঝলক দেখতেই সিনেমা হলে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুশান্ত। কিন্তু সেখানে যা ঘটেছে, তার পর আর নিজেকে সামলাতে পারেননি! প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই সুতপাকে কুপিয়ে খুন। খবর পুলিশ সূত্রে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৮:০৪
Share:
০১ ২০

প্রাক্তন প্রেমিকাকে এক ঝলক দেখতেই পৌঁছে গিয়েছিলেন সিনেমাহলে। কিন্তু সেখানে যা ঘটেছে, তার পর আর নিজেকে সামলাতে পারেননি! পূর্বপরিকল্পিত নয়, বরং ‘তীব্র ঘৃণা আর উগ্র প্রতিশোধস্পৃহা’ থেকেই সুতপা চৌধুরীকে কুপিয়ে খুনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুশান্ত চৌধুরী। পুলিশ সূত্রে উঠে এল এই তথ্য।

০২ ২০

গত বছর ২ মে-ই কেন প্রাক্তন প্রেমিকাকে খুন করেছিলেন সুশান্ত, আদালতে জমা পড়া চার্জশিটে তা উল্লেখ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেই মামলায় বৃহস্পতিবার সুশান্তর ফাঁসির শাস্তির নির্দেশ দিয়েছেন বহরমপুরের দ্রুত নিষ্পত্তি আদালতের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক সন্তোষকুমার পাঠক।

Advertisement
০৩ ২০

বহরমপুরের গোরাবাজারের ২৬/৮ শহিদ সূর্য সেন রোড— যা লোকমুখে স্যুইমিং পুলের গলি নামে পরিচিত। সেখানে একটি মেসবাড়িতে থাকতেন বহরমপুর গার্লস কলেজের প্রাণিবিদ্যার তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সুতপা। সেখান থেকে খানিটা দূরে শহরের জনপ্রিয় ‘মোহনের মোড়’। সেই মোড়েই একটি শপিংমলের ‘মাল্টিপ্লেক্সে’ বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে একাই হেঁটে মেসে ফিরছিলেন। আর তখনই তাঁর পিছু নিয়েছিল প্রাক্তন প্রেমিক সুশান্ত। মেসের সামনে গলিতে সুতপাকে একা পেয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাও করেছিলেন। তার পরেই কথা কাটাকাটি এবং শেষে ছুরি দিয়ে সুতপাকে কুপিয়ে খুন!

০৪ ২০

গত বছর ২ মে সন্ধ্যায় ৬ টা ৩৫ মিনিটে ওই তরুণীর চিৎকারে লোকজন ছুটে এসে ওই দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা সুতপাকে বাঁচাতে গেলে পিস্তল উঁচিয়ে (পরে পুলিশ জানতে পারে খেলনা পিস্তল) তাঁদের শাসাতেও দেখা যায় সুশান্তকে।

০৫ ২০

এলাকাবাসীরা জানান, সেই সময় সুশান্ত বলছিলেন, এক জনকে খুন করলেও যা হবে, দশ জনকে খুন করলেও তাই হবে। প্রত্যক্ষদর্শীদের শাসানোর সময়েও সুতপাকে ক্রমাগত কোপ মারতে থাকেন সুশান্ত। প্রকাশ্যে আসা ভিডিয়ো ফুটেজে তা দেখা গিয়েছে। সুতপা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লে সেখান থেকে পালিয়ে যান যুবক। পরে সেই দিন রাতেই তিনি শমসেরগঞ্জে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।

০৬ ২০

কিন্তু গত ২ মে-ই কেন সুতপাকে খুন? ধরা পড়ার পর পুলিশি জেরায় তা স্বীকার করেছিলেন সুশান্ত। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, সুশান্ত জানিয়েছিলেন, সুতপা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এলেও তাঁকে মন থেকে ভুলতে পারিনি তিনি। বিহারের একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশুনা শুরু করলেও মন টেকেনি সেখানে। শুধু মাত্র সুতপাকে দেখার নেশায় বহরমপুরের একটি মেসবাড়ি ভাড়া করেছিলেন।

০৭ ২০

মেসবাড়িতে থেকেই টানা এক মাস সুতপার টিউশন থেকে শুরু করে বান্ধবীদের সঙ্গে তাঁর ঘুরতে যাওয়া— সবটাই নজরে রাখতেন সুশান্ত। যেখানে সুতপাকে দেখার সুযোগ থাকত, সব কাজ ফেলে সেখানেই ছুটে যেতেন তিনি। সুশান্তই পুলিশকে জানিয়েছেন, তাঁর এই পিছু নেওয়া যে সুতপার নজরে পড়েনি, তা নয়। কিন্তু তরুণী তা এড়িয়ে চলতেন।

০৮ ২০

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সুশান্ত জেরায় স্বীকার করেছেন, ঘটনার দিন দুপুরে বহরমপুরের স্কোয়্যার ফিল্ডে নতুন প্রেমিকের সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়েছিলেন সুতপা। সেখানে একটি সিমেন্টের বেঞ্চে তাঁদেরকে বসে থাকতে দেখেছিলেন সুশান্ত।

০৯ ২০

পরে সুতপা এবং তাঁর প্রেমিক সিনেমা দেখতে যান। সুশান্তও তাঁদের পিছন পিছন যান। সুতপারা সিনেমাহলের ভিতরে ঢুকে যাওয়ার পর তিনি উল্টো দিকের একটি রেস্তরাঁয় অপেক্ষা করছিলেন।

১০ ২০

বিরতির সময় সুতপা ও তাঁর প্রেমিক বাইরে বেরিয়ে আসেন। সুশান্ত পুলিশকে জানিয়েছেন, সেই সময় তাঁদের ‘ঘনিষ্ঠতা’ দেখে সহ্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। তড়িঘড়ি সেখান থেকে ফিরে যান মেসে। জামার ভিতরে কাটারি ও প্যান্টের পকেটে খেলনা বন্দুক নিয়ে ফিরে আসেন ওই সিনেমাহলের সামনে।

১১ ২০

সিনেমা শেষ হলে আবার সুতপার পিছু নেন তিনি। সুতপার প্রেমিক সুতপাকে গোরাবাজারের কাত্যায়নীর গলির সামনে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এর পর সুতপা হাঁটতে হাঁটতে মেসের কাছে পৌঁছতেই সামনে আসেন সুশান্ত।

১২ ২০

সুতপার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাও করেন। কিন্তু তাঁকে দেখেই ছুটে মেসে ঢোকার চেষ্টা করেন সুতপা। সেই সময়েই কাটারি বার করে এলোপাথাড়ি কোপাতে শুরু করেন যুবক।

১৩ ২০

সুতপাকে কোপাতে গিয়ে নিজের হাতেও কোপ লাগে। কিন্তু তাঁর কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সুশান্তের বক্তব্য, সুতপার মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখান থেকে পালাতে পারছিলেন না।

১৪ ২০

সুশান্ত জানান, লোক জড়ো হয়ে যাওয়ায় খেলনা বন্দুক দেখিয়েই প্রতিবেশীদের হুমকি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। গণপিটুনি খাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকলেও সেই সব কিছুই তাঁর মাথায় আসেনি বলেই জানিয়েছিলেন সুশান্ত।

১৫ ২০

সুতপাকে খুন করে সুশান্তকে পালিয়ে যেতে দেখেছিলেন দুই প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁদের বয়ান রেকর্ডের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তদন্তের প্রাথমিক পর্ব। খতিয়ে দেখা হয় সিসিটিভি। যে মোবাইলে এই ঘটনা দৃশ্যবন্দি হয়েছিল, সেটিও খতিয়ে দেখে পুলিশ।

১৬ ২০

উদ্ধার করা হয় ঘটনার সময় ভয় দেখাতে ব্যবহার করা খেলনা পিস্তলটিও। একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে ঘটনার কয়েক দিন আগে সেটি কিনেছিলেন সুশান্ত। বয়ান রেকর্ডের জন্য ডাকা হয় ই-কমার্স সংস্থার প্রতিনিধিকে। যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে সুতপাকে খুন করা হয়েছিল, সেটি বহরমপুরের প্রাঙ্গণ মার্কেট এলাকার একটি দোকান থেকে কেনা হয়। সেই দোকানমালিক ও কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সুতপা যে মেসে থাকতেন, সেই মেসের মালিককেও তদন্তের আওতায় আনে পুলিশ।

১৭ ২০

ময়নাতদন্ত যিনি করেছিলেন, সেই চিকিৎসক আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে জানান, সুতপার দেহে মোট ৪২টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। আঘাত গুরুতর হওয়ায় রক্তক্ষরণের জন্য মৃত্যু হয়েছিল সুতপার।

১৮ ২০

শুনানি চলাকালীন মোট ৩৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে আদালত। ইলেকট্রনিক্স তথ্যপ্রমাণ হিসাবে একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ, মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ভিডিয়ো ফুটেজ, মোবাইল টাওয়ার লোকেশন, কল রেকর্ড, হোয়াট্‌সঅ্যাপ চ্যাট গ্রহণ করা হয়। মাত্র ১৫ মাসের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে আদালত।

১৯ ২০

সরকার পক্ষের হয়ে সাক্ষ্য দেন মৃতার বাবা-সহ দুই প্রত্যক্ষদর্শী, এক সাংবাদিক, ই-কমার্স সংস্থার প্রতিনিধি, দুই ব্যবসায়ী, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক, সুতপাকে মৃত ঘোষণা করা চিকিৎসক, পুলিশ এবং আরও অনেকে। প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে বান্টি ইসলাম সেই দিনের ঘটনার নৃশংসতা আদালতকক্ষে বর্ণনা করেন। চলতি মাসের ২৯ অগস্ট আদালত উভয় পক্ষের সওয়াল-জবাব শোনার পর সুশান্তকে ৩০২, ২০১, ২৮এ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে।

২০ ২০

মনোবিদদের একাংশের মতে, প্রেম-ভালবাসার সঙ্গে অধিকারবোধের এক রকম সম্পর্ক রয়েছে। সুতপার প্রত্যাখ্যান মানসিক ভাবে গ্রহণ করতে পারেনি সুশান্ত। প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি তরুণী অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় প্রতিশোধস্পৃহা তৈরি হয়েছিল সুশান্তের মধ্যে। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের মনোরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘হয় আমার, নয়তো কারও নও— এই প্রবণতা থেকেই সুশান্ত ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এটা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা।’’ বৃহস্পতিবার রায়ের পর একই কথা বলেছেন সরকারি আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান সমাজে যে কোনও সম্পর্ক থেকেই বেরিয়ে আসার অধিকার রয়েছে সকলের। যেটা মেনে নিতে পারেনি সুশান্ত। এটা এক ধরনের জঘন্যতম অধিকারবোধের উদাহরণ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement