দুয়ারে সরকার প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করার জন্য উপভোক্তাদের লাইন। ফাইল চিত্র।
চার-এ বেদ পেরিয়ে এ যেন চার-এ ভেদ। লক্ষ্যভেদ। যেমন-তেমন লক্ষ্য নয়, জনমন জয়ের মৎস্যচক্ষুভেদ।
‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, ছাত্রছাত্রীদের ‘ঋণ-কার্ড’, ‘দুয়ারে রেশন’ আর আর্থিক সুবিধা বাড়িয়ে নবকলেবরে ‘কৃষকবন্ধু’। তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফেরার লক্ষ্যে নির্বাচনী ইস্তাহারেই চারটি প্রধান সামাজিক প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। তাতে ছিল সরকারের ‘অভিমুখ বদল’-এর ইঙ্গিত। ফের ক্ষমতাসীন হয়েই প্রতিশ্রুত ওই চারটি মূল প্রকল্পের বাস্তবায়নে দ্রুত ঝাঁপিয়েছে নবান্ন। টানাটানির সংসারে খরচ সামলাতে পরিকাঠামোর পরিবর্তে সামাজিক ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানোকেই এখন পাখির চোখ করেছে রাজ্য। যদিও বিরোধী শিবিরের প্রশ্ন, এতগুলি কল্যাণ প্রকল্প চালিয়ে যেতে যে বিপুল টাকা প্রয়োজন, তা আসবে কোথা থেকে? বিশেষত বড়-মাঝারি শিল্প এ রাজ্যে তুলনায় কম থাকার কারণে রাজস্ব আদায় সীমিত হওয়ায় সেই সংশয় আরও বেশি।
প্রতিশ্রুতি এবং তা রক্ষার পিছনে আছে রাজনৈতিক চাপের ইতিবৃত্ত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই অভিমত, রাজনীতি আর উন্নয়ন— বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের এই জোড়া চাপ গত বিধানসভা নির্বাচনের লড়াইয়ে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলকে কঠিন লড়াইয়ের সামনে ফেলে দিয়েছিল। ক্ষমতা ধরে রাখতে রাজনৈতিক কৌশলের পাশাপাশি ভোটারদের আকৃষ্ট
করার মতো নতুন প্রতিশ্রুতি উদ্ভাবনে মন দিতে হয় তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ইস্তাহারে তুলে ধরতে হয় এমন চারটি প্রকল্প, যা ভোটারদের বৃহত্তর অংশের কাছে কোনও না-কোনও সুবিধা পৌঁছে দিতে পারে। তারই ফসল লক্ষ্মীর ভান্ডার, পড়ুয়াদের ঋণ-কার্ড, দুয়ারে রেশন ও নয়া কৃষকবন্ধু। সেগুলির সঙ্গে থাকছে স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজ সাথীর মতো আগের প্রকল্পগুলিও।
প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণ, এই প্রকল্পগুলির মাধ্যমে যুবক-যুবতী, গৃহবধূ, আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক মানুষ এবং কৃষক সম্প্রদায়ের মন পেতে চেয়েছে তৃণমূল সরকার। প্রধানত, সমাজের এই বিস্তীর্ণ পরিসরভুক্ত উপভোক্তারাই ভোটের ফলাফলের অন্যতম নিয়ন্ত্রক শক্তি। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন, ধীরে চলা অর্থনীতির চাকার গতি বাড়াতে মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়া জরুরি। আবার পরিবারের মহিলাদের হাতে নগদ পৌঁছলে তার সদ্ব্যবহারের সম্ভাবনা তুলনায় বেশি। সে-দিক থেকেও এই প্রকল্পগুলি সহায়ক হতে পারে। তৃণমূল সরকারের অর্থনীতি পরিচালনার অভিমুখও আপাতত সামাজিক প্রকল্প-নির্ভর হয়ে উঠছে।
নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম কয়েকটি বৈঠকেই প্রকল্পগুলিতে সিলমোহর দিয়ে দিয়েছে সরকার। দুয়ারে সরকার কর্মসূচির মাধ্যমে প্রকল্পগুলির সুযোগ-সুবিধা উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজও চলছে জোরকদমে। ইস্তাহারে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে উপভোক্তার সংখ্যা ১.৬ কোটি হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ওই প্রকল্পে আবেদন করেছেন অন্তত ১.৮ কোটি উপভোক্তা। কমবেশি দেড় কোটি উপভোক্তার আবেদন ইতিমধ্যে গৃহীত হয়েছে। ভোট থাকায় চারটি জেলা ছাড়া বাকি জেলায় উপভোক্তাদের টাকা দেওয়ার কাজও চলছে। এই খাতে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে বলে খবর। সরকারের অনুমান, ছাত্রছাত্রীদের ঋণ-কার্ড প্রকল্পে উপভোক্তার সংখ্যা হতে পারে দেড় থেকে দু’কোটি। দুয়ারে রেশন প্রকল্পে দেড় কোটি পরিবারকে এবং নতুন কৃষকবন্ধু প্রকল্পে ৬৮.৩৮ লক্ষ কৃষককে আনতে চায় রাজ্য।
দীর্ঘ মেয়াদে এই সব প্রকল্প চালিয়ে যেতে নতুনতর পরিকল্পনা করেছে নবান্ন। লক্ষ্মীর ভান্ডারে সাধারণ শ্রেণিভুক্ত গৃহবধূরা মাসে ৫০০ এবং তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত উপভোক্তারা ১০০০ টাকা পাবেন। সরকারের অনুমান, এতে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে। পড়ুয়াদের ঋণ-কার্ডে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যাবে ৪% সুদে। অতিরিক্ত সুদের ভার বহন করবে সরকার, প্রকল্পে খরচের অনুমান ২৫০ কোটি টাকা। নিখরচার রেশনের জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১৪০০ কোটি টাকা এবং সেই সামগ্রী ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে ধরা হয়েছে আরও ১২০০ কোটি। স্বাস্থ্যসাথীতে সরকার ধরে রেখেছে ১৯৭০ কোটি টাকা। কৃষকবন্ধু প্রকল্পে বর্ধিত আর্থিক সাহায্য দেওয়ার জন্য বছরে ৩৬০০ কোটি টাকা খরচ হতে পারে বলে সরকারের অনুমান।
বিরোধীদের প্রশ্ন, নড়বড়ে ভাঁড়ার নিয়ে কী ভাবে এই বিপুল খরচের ধাক্কা সামলাবে রাজ্য! তা হলে কি এই সব জনমুখী প্রকল্পের খরচ চালাতে পরিকাঠামোর মতো ক্ষেত্রে বরাদ্দ কাটছাঁট করা হবে? সম্প্রতি সরকার স্পষ্ট করে দিয়েছে, এই সব সামাজিক প্রকল্প চালিয়ে যেতে তারা বদ্ধপরিকর। তাই অপ্রয়োজনীয় খরচের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রকল্প তৈরির ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি চলবে।