এখনও তাজা সিঙ্গুর ক্ষত

রাজ্যে শিল্প চোখে পড়ছে না: রতন টাটা

তৃণমূলের জঙ্গি আন্দোলনের জেরে ছ’বছর আগে সিঙ্গুর থেকে ন্যানো কারখানা গুটিয়ে গুজরাতের সানন্দে চলে গিয়েছিলেন তিনি। নিতান্ত অনিচ্ছায়। এত দিন পরেও সেই ক্ষত যে শুকোয়নি, বুধবার কলকাতায় এসে সে কথা বুঝিয়ে দিলেন টাটা গোষ্ঠীর প্রাক্তন কর্ণধার ও বর্তমান এমেরিটাস চেয়ারম্যান রতন টাটা। ক্ষত তাঁর মনে। ক্ষত ন্যানো প্রকল্পেও। সিঙ্গুর ঘিরে অনিশ্চয়তার জেরে ভাবমূর্তির ক্ষতি সামলে উঠতে পারেনি একলাখি ছোট গাড়ি। কার্যত তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৪১
Share:

তৃণমূলের জঙ্গি আন্দোলনের জেরে ছ’বছর আগে সিঙ্গুর থেকে ন্যানো কারখানা গুটিয়ে গুজরাতের সানন্দে চলে গিয়েছিলেন তিনি। নিতান্ত অনিচ্ছায়। এত দিন পরেও সেই ক্ষত যে শুকোয়নি, বুধবার কলকাতায় এসে সে কথা বুঝিয়ে দিলেন টাটা গোষ্ঠীর প্রাক্তন কর্ণধার ও বর্তমান এমেরিটাস চেয়ারম্যান রতন টাটা।

Advertisement

ক্ষত তাঁর মনে। ক্ষত ন্যানো প্রকল্পেও। সিঙ্গুর ঘিরে অনিশ্চয়তার জেরে ভাবমূর্তির ক্ষতি সামলে উঠতে পারেনি একলাখি ছোট গাড়ি। কার্যত তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। কিন্তু নিজের সংস্থার চেয়েও পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের যে আরও বড় ক্ষতি হয়েছে, সে কথা এ দিন মনে করিয়ে দিয়েছেন রতন টাটা। বলেছেন, বিমানবন্দর থেকে পূর্ব কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে আসার পথে শিল্পায়নের কোনও চিহ্ন তাঁর চোখে পড়েনি। রাজ্যের শিল্পমহল বলছে, রাজারহাটের কয়েক কিলোমিটার পথটুকু আসতে গিয়েই রাজ্যের ছবিটা হাঁড়ির ভাত টেপার মতো করে বুঝে গিয়েছেন অভিজ্ঞ শিল্পপতি। রাজ্যের কোথাওই দূরবীন লাগিয়েও শিল্পের দেখা মিলবে না।

ন্যানো বিদায়ের ফলে তৈরি হওয়া অবিশ্বাসের বাতাবরণ যে এই পরিস্থিতির নেপথ্যে একটা বড় কারণ, তা মানছেন এ রাজ্যের শিল্পপতিরাও। সেই সঙ্গে দায়ী করছেন জমি নিয়ে শাসক দলের অনমনীয় অবস্থানকে। অথচ সিঙ্গুরের ন্যানো প্রকল্প ঘিরে আশার আলো দেখা গিয়েছিল সাত-আট বছর আগে। ২০০৬-এর মে মাসে তৎকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের প্রশংসা করে রতন টাটা বলেছিলেন, “যে দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রকল্প চূড়ান্ত করা হল, তাতে আমি মুগ্ধ।” আর ২০০৭-এর মার্চে তাঁর মন্তব্য ছিল, “বিনিয়োগের উপযুক্ত জায়গা পশ্চিমবঙ্গ।”

Advertisement

কিন্তু এর এক বছর পরেই বদলে যায় ছবিটা। সৌজন্যে ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের জমি ফেরানোর দাবিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জঙ্গি আন্দোলন। ৩ অক্টোবর, দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন সিঙ্গুর থেকে গুজরাতের সানন্দে ন্যানো কারখানা নিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করার সময় রতন টাটা বলেন, “বলেছিলাম মাথায় বন্দুক ঠেকালেও যাব না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ট্রিগার টিপে দিলেন।”

এ দিন বণিকসভার ‘লেডিজ স্টাডি গ্রুপের’ অনুষ্ঠানে সেই প্রসঙ্গ তুলে রতন টাটার মন্তব্য, “বলেছিলাম হয় ট্রিগার টিপুন, না হয় বন্দুক সরান। আমি মাথা সরাব না। আজও একই কথা বলছি।” এই মন্তব্যের পিছনে টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে বর্তমান রাজ্য সরকারের এখনও থেকে যাওয়া তিক্ত সম্পর্কেরই ছায়া দেখছে শিল্পমহল। টাটাদের কাছ থেকে সিঙ্গুরের জমি রাজ্য অধিগ্রহণ করে নেওয়ার পরে জল গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। মাঝে দু’পক্ষের মধ্যে ‘ট্র্যাক টু’ আলোচনায় সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা হলেও বরফ বিশেষ গলেনি বলেই খবর।

এবং রাজ্য-টাটা সংঘাতের প্রেক্ষাপটে আরও মলিন হয়েছে শিল্পায়নের ছবি। মহাকরণ দখলের পরে শিল্পের জন্য এক ছটাকও জমি অধিগ্রহণ করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন মমতা। এই জমি নীতি এবং তৃণমূল নেতা-কর্মীদের জুলুম-তোলাবাজির কারণে রাজ্যে নতুন শিল্প আসা তো দূরস্থান, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক কারখানা। সরকারের অবশ্য দাবি, বাম জমানার তুলনায় অনেক বেশি লগ্নি আসছে রাজ্যে। খোদ মুখ্যমন্ত্রীও গত কয়েক দিনে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শিল্পায়ন নিয়ে নানা তথ্য দিয়েছেন। লগ্নি টানতে এ মাসের মাঝামাঝি সিঙ্গাপুরেও যাচ্ছেন তিনি। যে সিঙ্গাপুর, রতন টাটার মতে, ব্যবসা করার পক্ষে বিশ্বের সব চেয়ে ভাল জায়গা। অতএব সিঙ্গাপুর থেকে মুখ্যমন্ত্রী কিছু শিল্প-শিক্ষা নিয়ে ফিরবেন, আশায় শিল্প মহল।

আপাতত অবশ্য রাজ্যের ছবিটা মলিনই। এ দিন রতন টাটাকে প্রশ্ন করা হয়, পশ্চিমবঙ্গের কোনও পরিবর্তন কি চোখে পড়ল? তাঁর জবাব, “দু’বছর পরে কলকাতা এলাম। এর মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নের ছবিটা এখনও গ্রামীণ এলাকার মতোই। কিছু বাণিজ্যিক কাজকর্ম দেখলাম। তবে শিল্পায়নের চিহ্ন নজরে পড়ল না।”

প্রবীণ শিল্পপতির সঙ্গে শিল্প মহল তো একমতই, বিরোধী দলগুলিও মনে করছে রতন টাটার মন্তব্যে তাদের সমালোচনাই মান্যতা পেল। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “রতন টাটা বা অন্য যে-ই বলুন, এটাই পশ্চিমবঙ্গের বাস্তব পরিস্থিতি। সিঙ্গুর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে শিল্প-বিরোধী প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, সরকারে গিয়ে এখনও তা অব্যাহত!” আর বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মন্তব্য, “আমরা সাধারণ মানুষ হয়ে যা বুঝতে পারছি, পাকা শিল্পপতি হিসেবে টাটা সহজেই সেটা বুঝতে পেরেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, শিল্পায়নের কোনও উদ্যোগ এ রাজ্যে চোখে পড়ছে না। সরকার প্রোমোটার-সিন্ডিকেট-তোলাবাজি নিয়েই খুশি!”

এর বিপরীতে কোনও মন্তব্য করতে চাননি শাসক দলের নেতারা। শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া মেলেনি। আর প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলে দিয়েছেন, “এ ব্যাপারে আমি কোনও মন্তব্য করতে পারছি না।” একান্ত আলোচনায় তৃণমূল শিবিরের অবশ্য দাবি, একের পর এক নির্বাচনে তাদের পক্ষে রায় দিয়ে মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন, সিঙ্গুরে দল কোনও অন্যায় করেনি। যে মনোভাবকে শিল্পায়নের পরিপন্থী একগুঁয়ে অবস্থান হিসেবেই দেখছে শিল্পমহল।

এ দিন রতন টাটার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কোনও রাজ্যে শিল্পের অনুকূল আবহাওয়ার জন্য কী কী চাই? তাঁর বক্তব্য, সম্পূর্ণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। সরকারের ভূমিকা হতে হবে সহায়কের, বাধাদানকারীর নয়। শিল্প মহল বলছে, রাজ্যের স্বার্থে সহযোগীর ভূমিকা নিতে হয় বিরোধীদেরও। মহারাষ্ট্র, গুজরাতের মতো রাজ্যে শিল্পের ক্ষেত্রে শাসক-বিরোধী সব পক্ষই পারস্পরিক বিরোধিতা দূরেসরিয়ে রাখে। অথচ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের একরোখা বিরোধিতার জেরে পাততাড়ি গোটাতে হয়েছিল টাটাদের। আর তার জেরে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে ন্যানো প্রকল্পই।

টাটা বলেন, চূড়ান্ত প্রতিকূল অবস্থার মুখে দাঁড়িয়েই তিনি ন্যানো প্রকল্প সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমনকী, বিকল্প জায়গা পাওয়ার আগেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি নিতে তিনি বাধ্য হন। কারণ সিঙ্গুরের গোলমাল শুধু ওই কারখানা বা প্রকল্প নয়, টাটা গোষ্ঠীর উপর মানুষের বিশ্বাসকেই নাড়িয়ে দিচ্ছিল। সানন্দে গিয়েও ন্যানো সেই হারানো বিশ্বাস ফিরে পায়নি বলেই দাবি করেছেন টাটা। তাঁর কথায়, “সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়ার চড়া দাম চোকাতে হয়েছিল। ন্যানোর বিপণনে তার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।”

রতন টাটার বক্তব্য, ন্যানো তৈরির কথা ঘোষণার সময় এতটাই উন্মাদনা ছিল যে, গাড়ি তৈরির আগেই প্রায় তিন লক্ষ বুকিং হয়েছিল। কিন্তু সানন্দে কারখানা সরানোর মাঝে যে সময় নষ্ট হয়, তাতে সেই উন্মাদনা ছিল না।

সিঙ্গুর-পর্ব টাটাদের যে ক্ষতি করেছে, এ রাজ্যের ক্ষতি তার চেয়ে অনেক বেশি বলেই শিল্পমহলের মত। টাটাদের সঙ্গে সমঝোতা করে তাদের রাজ্যে ফেরানোর ব্যবস্থা করলে যে ভাবমূর্তি মেরামত করা যেত, সে কথা অনেক বারই বলেছেন বহু শিল্পপতি। বিধানসভায় সম্প্রতি সেই প্রস্তাব দেন কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়াও। তিনি এ দিন বলেন, “২০১৬ সালের ভোট পর্যন্ত সিঙ্গুরের মানুষকে দু’টাকা কেজি চাল আর দু’হাজার টাকা ভাতা নিয়েই বসে থাকতে হবে। জমিও তাঁদের কাছে ফিরবে না, শিল্পও আসবে না!”

দিনের শেষে তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার স্বীকারোক্তি, “রতন টাটার মতো শিল্পপতিদের সঙ্গে সম্পর্ক ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপনের চেষ্টা কিছুটা এগিয়েছিল। কিন্তু সরকারের মনোভাব সম্পর্কে যে বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে শিল্পমহল এখন আর আস্থা রাখতে পারছে না।”

প্রশ্নবাণেও সপ্রতিভ রতন টাটা
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

প্রেমে পড়েছেন, কিন্তু বিয়ে করেননি। বুধবার কলকাতায় লেডিজ স্টাডি গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে আলাপচারিতায় সে সবই বলছিলেন সাতাত্তর বছরের রতন টাটা। বলছিলেন, তাঁর প্রথম প্রেম আমেরিকায় থাকার সময়। ব্যস, এইটুকুই। এর বেশি জানার দরকার নেই, হাসিমুখে বলেন টাটা। একই সঙ্গে তাঁর সহাস্য টিপ্পনি, এত জন মহিলার মুখোমুখি হয়ে ভীত তিনি! নিজেই বিমান চালিয়ে কলকাতায় এসেছেন। তেমনই সপ্রতিভ মেজাজে জবাব দিলেন ‘র্যাপিড ফায়ার’ প্রশ্নের। টাটা জানালেন, তাঁর প্রিয় গাড়ি ফেরারি। তবে প্রিয় হোটেল টাটা গোষ্ঠীর তাজ বেঙ্গল। প্রিয় লেখক উইলবার স্মিথ। জানান, তাঁরা এমআইটি-র (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) সঙ্গে নতুন কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে চান মুম্বইয়ে। শেষ লগ্নে রাজনীতিতে আসার প্রসঙ্গে যাঁকে বরাবর ‘মেন্টর’ বলে মেনে এসেছেন রতন টাটা, সেই জেআরডি টাটার মতোই জানালেন, রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রশ্ন নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement