অজিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
লোকগাথায় শোনা যায় ফিনিক্স পাখির কথা। ধ্বংসের মধ্যে থেকে নতুন করে প্রাণ পায় পাখিটা। নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল আরাবাড়ি। ফিনিক্সের মতোই। তবে লোকগাথার ফিনিক্সের থেকেও আরাবাড়ির কৃতিত্ব বেশি। কারণ আরাবাড়ি শুধু নিজে বেঁচে ওঠেনি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বনাঞ্চলের টিকে থাকার, লড়াই করার পথ দেখিয়েছিল। বনবাসী মানুষদের বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়েছিল।
পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি এলাকার বনাঞ্চল আরাবাড়ি। রানিগঞ্জ-মেদিনীপুর জাতীয় সড়কের ধারে অবস্থিত এই বনাঞ্চলকে এখন দেখলে এর লড়াইয়ের অতীত কিছু বোঝা যাবে না। আরাবাড়ি এখন পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বেশ নামী। কিন্তু গত শতাব্দীর ৭০ এর দশকে ধ্বংস হতে বসেছিল বনাঞ্চলটি। সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়ায়। আর সেই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে আরাবাড়িকে সাহায্য করেছিলেন এক বনাধিকারিক। তৎকালীন মেদিনীপুরের ডিএফও অজিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। বনবাসী এবং জঙ্গলের অধিকার, দুয়ের চিরকালীন দ্বন্দ্বের সমাধানের পথ খুঁজে দিয়েছিলেন অজিতবাবু। সেই সঙ্গে জঙ্গলরক্ষার নতুন চিন্তাও।
ফিরে যাওয়া যাক ৭০ এর দশকে। মেদিনীপুরের ডিএফও হয়ে এলেন অজিতবাবু। এসে কী দেখলেন? দেখলেন, আরাবাড়ি বনাঞ্চলের অস্তিত্ব প্রায় নেই। এই বনাঞ্চল মূলত শালগাছের জঙ্গল। এলাকার বাসিন্দারা জ্বালানি, ঘর তৈরির জন্য গাছ কেটে সাফ করে দিয়েছেন। গাছ চুরি তো ছিলই। তখন জ্বালানি রাজ্যে একটা বড় সমস্যা। জঙ্গলের গাছ সাফ হয়ে কলকাতাতেও চালান হতো। অজিতবাবু দেখলেন, এরকম চলতে থাকলে এলাকার পরিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্র তো শেষ হবেই। জঙ্গলনির্ভর এলাকার বাসিন্দারাও কিছুদিন পরে কোনও সম্পদও পাবেন না। জ্বালানি তো দূর অস্ত তাঁদের গৃহপালিত পশুরাও কোনও খাবার পাবেন না।
বন সুরক্ষা কমিটির খতিয়ান
ঝাড়গ্রাম: ৪৭২টি রূপনারায়ণ: ২১৬টি মেদিনীপুর:৩৮৬টি খড়্গপুর:২০০টি
বনাঞ্চলের পরিমাণ:
ঝাড়গ্রাম: ৬২০ বর্গকিলোমিটার খড়্গপুর: ৩০০ বর্গ কিলোমিটার রূপনারায়ণ: ২৯৯ বর্গ কিলোমিটার মেদিনীপুর: ৫৬২ বর্গ কিলোমিটার।
পুরনো নাম: বন সুরক্ষা কমিটি। নতুন নাম: যৌথ বন পরিচালন কমিটি। সদস্য সংখ্যা লক্ষাধিক।
আড়াবাড়ির মোট আয়তন:৭৬০২ হেক্টর। জঙ্গল মূলত শাল গাছের। এছাড়াও রয়েছে মহুয়া, ইউক্যালিপটাস, নিম, জাম, সেগুন প্রভৃতি।
সেই সময়টাও রাজনীতির কারণে উত্তপ্ত। বন দফতরের পক্ষ থেকে জঙ্গল রক্ষার উদ্যোগ করা হল। উদ্যোগী হলেন অজিতবাবু। সঙ্গে পেয়েছিলেন সমমনোভাবাপন্ন সহকর্মী পদস্থ বনাধিকারিক সুবিমল রায়কে। কিন্তু কোন পথে জঙ্গল এবং মানুষ, দু’জনকেই একসঙ্গে রক্ষা করা যাবে? পথ বের করলেন অজিতবাবু। বনবাসীদের সাহায্য ছাড়া বন রক্ষা যে এক প্রকার অসম্ভব, সেটা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। বাসিন্দাদের সাহায্য ছাড়া নতুন বনাঞ্চল তৈরি তো দূরের কথা যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকু রক্ষা করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
আরও পড়ুন: চোরাশিকার বন্ধে ভরসা এসএসবি
ভাবনার মূল বাধা তো বাস্তব প্রয়োগে। এতদিন যাঁরা জঙ্গলের সম্পদ নির্বিচারে আহরণ করে তাকে ধ্বংস করেছেন এক বনাধিকারিকের কথায় তাঁরা রাতারাতি সেসব রক্ষায় মন দেবেন? একমাত্র উপায় জঙ্গল থেকে বাসিন্দাদের দৈনন্দিন চাহিদা মিটবে, এই সত্যটা তাঁদের উপলব্ধি করানো। সেই সঙ্গে জঙ্গল নির্ভর কিছু উপার্জনের পথও খুঁজে দিতে হবে তাঁদের। তাহলে সাফল্য আসতে পারে। এমনিতেই তখন গ্রামের মানুষ আর্থিক সঙ্কটে। কাজ নেই। পেট চালাতেই তাঁরা গাছ কেটে বিক্রি শুরু করেছিলেন। মানুষজনকে জঙ্গলের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে পায়ে হেঁটে গ্রামে গ্রামে যেতে শুরু করলেন তিনি আর সুবিমলবাবু। সরকারি গাড়ি রেখে হাঁটলেন মাইলের পর মাইল। পরিচয় করতেন লোকজনের সঙ্গে। গল্প করতেন তাঁদের সঙ্গে। জানতে চাইতেন জঙ্গল সম্পর্কে কী ধারণা তাঁদের।
কর্মজীবন শুরু করেছিলেন উত্তরবঙ্গের রাজাভাতখাওয়ায়। বন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন সারা বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু বন আধিকারিক অজিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিশ্ব চেনে যৌথ বন ব্যবস্থাপনা’র জনক হিসেবে।
কিন্তু বনের মানুষটি লিখতেন গল্পও। দেশ, আনন্দবাজারে তাঁর ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। লিখেছেন একটি উপন্যাসও। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে থেকে তাঁর স্মৃতিচারণমূলক বই বেরিয়েছিল, ‘মনে বনে বনান্তরে’। তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে মানুষটির পরিচয় আরাবাড়ির সঙ্গে জুড়ে। ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গের বন সুরক্ষা কমিটি আন্তর্জাতিক পল গেটি পুরস্কার পায়। পুরস্কারের কৌলীন্য? আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন হোয়াইট হাইসের লনে এই পুরস্কার দিয়েছিলেন। তাঁর মূল্যায়ন, পল গেটি পুরস্কার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার।
অজিতবাবু ২২ বছর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন বিভাগ এবং ভারত সরকারের বন সম্পর্কিত কাজে যুক্ত ছিলেন। পরে বন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশ্বব্যাঙ্কে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত চিনের বিভিন্ন গ্রামে বন সংরক্ষণ এবং বনবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করেছিলেন। চিন ছাড়াও অজিতবাবুর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছিল এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বই। আরাবাড়ি থেকে বদলি হওয়ার পরেও সেখানকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। সেখানকার সাতশোল গ্রামের নান্টুমোহন ঘোষের ছেলে মৃণালকান্তি ঘোষ বলেন, “অজিত বাবুর সবসময়ের সঙ্গী ছিলেন আমার বাবা। কমিটি গড়তে বাবারও একটা অবদান ছিল। তাই অজিতবাবু খুব ভালবাসতেন বাবাকে। বন দফতরের মন্ত্রী থেকে উচ্চপদস্থ অফিসারেরাও বাবার নাম একডাকে চিনতেন।”
কেমন ছিল সেই দিনগুলো? আড়াবাড়ি জঙ্গল লাগোয়া সাতশোল গ্রামের নান্টু মোহন ঘোষ অজিতবাবুর সঙ্গে কাজ করেছেন। নান্টুবাবু অজিতবাবুর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে জঙ্গলের মানুষদের নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলেন। তাঁদের বোঝাতে শুরু করলেন, জঙ্গল বেঁচে থাকলে তাঁরাও বেঁচে থাকবেন। ভালভাবে বেঁচে থাকবেন। গাছ রক্ষা করলে সেই গাছ বিক্রির পরে লাভের টাকার চার ভাগের এক ভাগ গ্রামবাসীরাই পাবেন। অজিতবাবু গ্রামের মহিলাদেরও বোঝাতে পেরেছিলেন জঙ্গলের গুরুত্ব। রাজি হলেন গ্রামবাসীরা।
তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক বন সৃজন প্রকল্প শুরু হয়েছে। ওই প্রকল্পে নতুন নতুন বনাঞ্চল তৈরি শুরু হল। পড়ে থাকা লাল-কাঁকুরে মাটিতে গাছ লাগানো কাজে ব্যবহার করা হল তাঁদের। তৈরি করা বনাঞ্চল রক্ষার জন্য তৈরি হল আড়াবাড়ি সামাজিক বন সুরক্ষা কমিটি। বনাঞ্চল লাগোয়া ১১টি গ্রামের ৬১৮টি পরিবারকে যোগ করা হল কমিটিতে। গ্রামগুলো হল, আড়াবাড়ি লাগোয়া গ্রাম গুলির নাম: চাঁদমুড়া, সাতশোল, মাঝিগড়, সাকরই, সাফাডিহা, গুতিয়ামারা, সখিশোল, গুঁচিশোল, উরামি, জোড়া কেউদি ও মহিষডুবি। কমিটিতে ছিলেন মহিলারাও। কমিটির মাধ্যমে কাজ পেলেন গ্রামবাসীরা। ভূমিহীন কৃষক, বন মজুরেরা কাজ পেতে লাগলেন নিয়মিত।
গ্রামবাসীরা প্রতিশ্রুতি দিলেন নতুন লাগানো গাছ রক্ষার। পরিবর্তে তাঁরা পেলেন জঙ্গলের কিছু সম্পদের ওপরে অধিকার। জ্বালানির জোগান, পশুচারণের জায়গা। এছাড়া অজিতবাবু বনভূমিতে বাবুই ঘাস, পাট, বাঁশ লাগানোর ব্যবস্থা করলেন। যাতে বাবুই দড়ি, বাঁশের ঝুড়ি-সহ নানা প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করে কিছু আয় হয় এই জনপদের বাসিন্দাদের। সঙ্গে মাশরুমও। আড়াবাড়ি লাগায়ো গ্রামের বাসিন্দা বীরেন্দ্রনাথ ভুঁইয়া অজিতবাবুর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। প্রথম বনসুরক্ষা কমিটির সদস্যও ছিলেন। তিনি বলছিলেন, “মাঝে মধ্যেই কথাটা বলতেন স্যার। আমি এখন তো তোমাদের বিশ্বস্ত হতে পারব না। যখন তোমাদের সরকার টাকা দেবে তখন তোমরা আমায় বিশ্বাস করবে। কত লড়াই করতে হয়েছিল ওঁকে।” পুরনো লোকেরা মনে করতে পারেন, জঙ্গল রক্ষা করতে জরিমানার ব্যবস্থাও চালু হয়েছিল। বেআইনি ভাবে গাছ কাটলে দু’টাকা থেকে পাঁচ টাকা জরিমানা করা হতো। জরিমানার পরিমাণ বেশি করার পক্ষপাতী ছিল না বন সুরক্ষা কমিটি। কারণ বেশি অঙ্কের জরিমানা গ্রামবাসীরা দিতেও পারবেন না। দিতে বাধ্য করা হলে তাঁরা জঙ্গল থেকেই সেই টাকা উসুলের চেষ্টা করবেন।
১৯৭২ সালে শুরু হয়েছিল জঙ্গল বাঁচানোর, জঙ্গল তৈরির লড়াই। সাফল্য এল ১৯৮৭ সালে। ওই বছরেই জঙ্গলের একটি অংশের কাঠ বিক্রি হল। লভ্যাংশের ২৫ শতাংশ সমান ভাবে বণ্টন করা হল গ্রামবাসীদের। টাকা বিলি করতে সাতশোল গ্রামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এসেছিলেন অজিতবাবুও। স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন পঞ্চানন মাহাতো। বলছিলেন, “আমার বাবা কলিঙ্গ মাহাতো সামাজিক বন সুরক্ষা কমিটির সদস্য ছিলেন। প্রথম টাকা পেয়ে আমাকে একটা গেঞ্জি কিনে দিয়েছিলেন।” বন দফতরের এক তথ্য অনুযায়ী, প্রথমবার গ্রামবাসীরা মাথাপিছু ৭০০ টাকা পেয়েছিলেন।
সফল হল আরাবাড়ি। সফল হলেন অজিতবাবু। আরাবাড়ির সাফল্যে উৎসাহিত কেন্দ্রীয় সরকার। আরাবাড়ি মডেল প্রয়োগ করা হল হরিয়ানায়। আবার সাফল্য বন সুরক্ষায় মডেলটি সারা দেশে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিল কেন্দ্র। গ্রামবাসীদের নিয়ে জঙ্গল রক্ষা করার ব্যবস্থা যৌথ বন ব্যবস্থাপনা (জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট) তখন স্বীকৃত মডেল। এ বিষয়ে ভারত সরকার ১৯৯০ সালে নির্দেশিকা তৈরি করে। যা এখন সারা দেশে মেনে চলা হয়। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলল অজিতবাবুর মডেলের। পশ্চিমবঙ্গ বনসুরক্ষা কমিটি পল গেটি পুরস্কার পেল। বিভিন্ন দেশে আরাবাড়ি মডেল মেনে চলা হয়।
বিশ্বকে পথ দেখাল আরাবাড়ি। এখন সে কেমন আছে? একটি পরিসংখ্যান, ১২৭২ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন অজিতবাবু। এখন তার আয়তন ৭৬০২ হেক্টর। সুরক্ষা কমিটির সদস্যরাই বন দফতরের সম্পদ। জঙ্গল বাঁচানো-সহ নানা কাজেই তাঁদের ব্যবহার করা হয়। হাতি তাড়ানোর সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে কমিটির সদস্যদের। এখন আর্থিক বছরের গোড়ায় অজিত বাবুর হাত ধরে তৈরি সেই কমিটির সদস্যদের কাছে জঙ্গলের সম্পদ বাড়াতে তাঁদের মতামতও নেওয়া হয়। জঙ্গলের লভ্যাংশে গ্রামগুলোর পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটছে। বন কমিটিকে এখন চল্লিশ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া। এলাকায় পানীয় জলের ব্যবস্থা, স্কুল তৈরি, জলাশয় খনন-সহ নানা পরিকাঠামো উন্নয়নেও বন দফতর এগিয়ে এসেছে। গাছের ছাল থেকে জ্বালানি পান বাসিন্দারা। এখন আরাবাড়িতে একটি গবেষণা কেন্দ্রও তৈরি করা হয়েছে। সেখানকার নার্সারিতে তৈরি করা হয় শাল চারা। বিভিন্ন দেশ থেকে আরাবাড়ি মডেল নিয়ে খোঁজখবর নিতে আসেন পরিবেশকর্মী, বন নিয়ে কাজ করা মানুষজন। জাপানের একটি সংস্থা এখানে কাজ করছেন।
বাসিন্দারা মনে রেখেছেন অজিতবাবুকে? আরাবাড়ি সিলভিকালচার বিট অফিসার সৌমিক কুণ্ডু এবং বিট অফিসার অসীম ঘোষ বলছিলেন, “এখনও জঙ্গল লাগোয়া মানুষজন অজিতবাবুকে খুব ভালবাসেন। সুরক্ষা কমিটির বয়স্ক সদস্যরা আমাদের সেই সময়ের গল্প বলেন। শুনতে ভাল লাগে। আমরা উৎসাহিত হই।’’