Delayed Winter

হিমের পরশ?

আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার সম্মিলিত উদ্যোগে নিরন্তর সুসিদ্ধ হতে হতে বঙ্গজন শেষ অবধি অগ্রহায়ণে উপনীত। আজ সেই মাসের প্রথম দিন। এক কালে এই দিনটির বিশেষ মহিমা ছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৩১
Share:

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

পাঠ্যপুস্তকের মতে ভাদ্র-আশ্বিন শরৎকাল, কিন্তু কেতাবি বিদ্যা আর বাস্তব অভিজ্ঞতা কবেই বা মিলেছে? বঙ্গদেশের কবি তো সেই কোন কালেই ‘এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর’ লিখে পাঠকের মেঘভারাক্রান্ত মন আরও ভারী করে গিয়েছেন। আর, কালের গতিকে আশ্বিনও এখন শ্বাসরোধকর আর্দ্র উত্তাপের কবলে— এই ঘর্মাক্ত বদ্ধভূমিতে বসে ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ’ আওড়াতে বললে বালকবালিকারাও ফিক করে হাসবে। দোষ কালের নয়, মানুষের। জীবজগতের এই মহাপ্রাণীটি যত সভ্য এবং উন্নত হয়েছে, এই গ্রহের স্থলে জলে অন্তরিক্ষে তার দাপট ততই বেড়েছে। বিশেষত গত আড়াইশো বছরে, শিল্পবিপ্লব এবং তার উত্তরকাণ্ডের ঠেলায় এখন অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়ে উঠেছে যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রে নীলকণ্ঠ-রূপী ঋত্বিক ঘটকের সেই ঘোষণা: ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে! পৃথিবীর জলবায়ুতে আগুন লাগলে বাঙালির শরৎই বা তার অমল মহিমা নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে অথবা কমলবনে রক্ষা পাবে কী করে? বস্তুত, বিশ্ব উষ্ণায়নের অগ্নিবলয় ইদানীং গ্রাস করে ফেলেছে বিধিবদ্ধ হেমন্তঋতুর প্রথম মাসটিকেও। এই ১৪৩১ বঙ্গাব্দে ‘কচি সংসদ’ লিখতে বসলে পরশুরাম গোটা কার্তিক মাসের একটি দিনের কথা ভেবেও ‘শেষরাত্রে একটু ঘনীভূত হইয়া শুইতে হয়’ গোছের বাক্য লিখতে পারতেন না, তাঁর সত্যনিষ্ঠ কলম সরত না কিছুতেই।

Advertisement

অতএব, আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার সম্মিলিত উদ্যোগে নিরন্তর সুসিদ্ধ হতে হতে বঙ্গজন শেষ অবধি অগ্রহায়ণে উপনীত। আজ সেই মাসের প্রথম দিন। এক কালে এই দিনটির বিশেষ মহিমা ছিল। নামেই তার পরিচয় নিহিত আছে: অগ্রহায়ণ শব্দের আদি অর্থ বৎসরের প্রথম মাস। এই মাসের অন্য নাম মার্গশীর্ষ। গীতার দশম অধ্যায়ে পার্থসারথি নিজের সর্বময় মহিমার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে বলেন, ‘মাসের মধ্যে আমি মার্গশীর্ষ’। এক নিঃশ্বাসেই অবশ্য তিনি জানিয়ে দেন ‘ঋতুর মধ্যে আমি কুসুমাকর অর্থাৎ বসন্ত’, তবে তার ফলে বর্ষারম্ভের গৌরব কিছুমাত্র খর্ব হয় না। কেন অগ্রহায়ণ ছিল বার্ষিক গতির শীর্ষ বা প্রথম মাস, সে-কথা সহজেই বোঝা যায়। কৃষিজীবী জনসমাজে ফসল ওঠার সময়টিই নতুন বছর শুরু করার পক্ষে প্রশস্ত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তদুপরি জলবায়ুর দাক্ষিণ্য: গ্রীষ্মপ্রধান এবং বর্ষণমুখর দেশে বছরের এই সময়টিতে স্বচ্ছ আকাশ এবং হিমেল বাতাস জানিয়ে দিত, সুখের দিন সমাগত। দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ অবশ্যই সেই আহ্লাদে বঞ্চিত, তাঁদের জীবনে বছরের এই সময়টি হাড়-হিম-করা দুর্গতির। শিশুপাঠ্য দ্বিপদীতেও আছে সেই বাস্তবের স্বীকৃতি: ‘উঃ কী শীত/ কষে গাও গীত’। কষে গীত গাওয়া ছাড়া গরিবের শীত-তাড়ানোর আর কোনও উপায় নেই, সেই সুকঠিন সত্যটি শিশুদের কাছে ফাঁস করে দিতে সে-কালের লেখক দ্বিধাহীন ছিলেন। তবে কিনা, ঋতুচক্রের সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি, উৎসব ইত্যাদির কথা ও কাহিনি রচনায় শ্রমজীবী মানুষের কথা স্রষ্টারা কতটুকুই বা মনে রেখেছেন? সুতরাং কালক্রমে মার্গশীর্ষের আসন থেকে বিচ্যুত হলেও এই মাসটি বাঙালির সামাজিক জীবনে অনেক কাল অবধি সমাদর পেয়ে এসেছে। তার একটি উৎকৃষ্ট নজির আছে বিবাহের বর্ষপঞ্জিতে। আজও বঙ্গসমাজের একটি বড় অংশে বিবাহের কাল হিসাবে এই মাসটির বিশেষ আকর্ষণ আছে, যে আকর্ষণ তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঐতিহ্যের চিহ্নবাহী।

যে কৃষিব্যবস্থা এবং তার উপর ভিত্তিশীল সামাজিক জীবনধারা থেকে এই ঐতিহ্যের উদ্ভব, আজ তা বহুলাংশে স্মৃতিমাত্র। তা নিয়ে আক্ষেপের কোনও যুক্তি নেই, যুগের সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবতই অর্থনীতি বদলাবে, সমাজও তার অনুগামী হবে। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। সে-প্রশ্ন পরিবর্তনের গতি এবং প্রকৃতি নিয়ে। যে গতিতে এবং যে ভাবে অর্থনীতির রূপান্তর ঘটছে, তার প্রভাবে সমাজের চেহারা ও চরিত্রে রাতারাতি অকল্পনীয় পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে, তাকে কি যুগধর্ম বলে স্বাভাবিক বলে স্বীকার করা যায়? অন্য সব তর্ক সরিয়ে রাখলেও একটি প্রশ্নকে কোনও ভাবেই সরানো যাবে না। সেটি অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। ‘মানবসভ্যতা’র এমন অভূতপূর্ব অভিঘাত এই গ্রহ আর কত দিন সহ্য করতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তরে দুনিয়ার প্রকৃতি এবং পরিবেশ প্রতি মুহূর্তে যে অগণন সঙ্কেত দিয়ে চলেছে, তার মর্মার্থ অতি স্পষ্ট: শিয়রে শমন। মার্গশীর্ষের এই প্রথম দিবসে বঙ্গভূমির বিজাতীয় আকাশে এবং বাতাসে সেই সঙ্কেতই প্রকট। শরৎ, হেমন্ত বা শীত— শব্দগুলি থাকবে, তাদের অর্থ উত্তরোত্তর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে অচিরেই বোধ করি দিগন্তে বিলীন হয়ে যাবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement