কাদের হাতে থাকবে শহরের অতি পরিচিত ৮টি কলেজের ভাগ্য, তা নিয়ে নতুন পর্বে মামলা শুরু হচ্ছে কলকাতা হাইকোর্টে। যেখানে ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে লড়াই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। হাইকোর্টে আইনজীবীদের কর্মবিরতির আগে মামলাটি ছিল বিচারপতি দেবাংশু বসাকের এজলাসে। আগামী ১৫ মে মামলা শুরু হবে বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর এজলাসে।
বহু বছর ধরে নিজেদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় অস্তিত্বের স্বীকৃতির দাবিতে লড়াই করছে ব্রাহ্ম সমাজ। তাদের দাবি, কোনও ভাবেই তারা হিন্দু নয়। ব্রাহ্ম সমাজের তত্ত্বাবধানেই ছিল কলকাতার অতি চেনা ৮টি কলেজ— সিটি, রামমোহন, আনন্দমোহন, উমেশচন্দ্র, সিটি কলেজ অব কমার্স অ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, শিবনাথ শাস্ত্রী, হেরম্বচন্দ্র এবং প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ।
অভিযোগ, গত বছর রাজ্য সরকার এই কলেজগুলিতে ব্রাহ্ম সমাজ এডুকেশন সোসাইটির পরিচালন সমিতি ভেঙে দিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই নতুন করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় ব্রাহ্ম সমাজ। দু’টি বিষয়কে কেন্দ্র করে শুরু হয় নতুন মামলা। এক, নিজেদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু তকমার দাবি এবং দুই, ৮টি কলেজে অধিকার স্থাপন।
সমস্যার উৎস সন্ধানে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসে। ১৯৮৩ সালে প্রথম বার ব্রাহ্ম সমাজ সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় নিজেদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় স্বীকৃতির দাবিতে। ১৯৮৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি অন্তর্বর্তিকালীন আদেশে বলে, কলেজ সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে ৩ জন শিক্ষক ব্রাহ্ম সমাজের পরিচালনাধীন কলেজগুলিতে আবেদন করতে পারবেন। সেখান থেকে পছন্দের এক জনকে নিয়োগ করতে পারবেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। এমনকি, প্রার্থী পছন্দ না হলে কাউকে নিয়োগ না-ও করতে পারেন তাঁরা। সে ভাবেই এ যাবৎ নিয়োগ হয়ে এসেছে বলে কর্তৃপক্ষের দাবি।
২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি-সহ ৫ সদস্যের বেঞ্চ রায় দেয়, নিজেদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় স্বীকৃতির জন্য ব্রাহ্ম সমাজকে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের কাছে আবেদন করতে হবে। কমিশন তাদের পাঠিয়ে দেয় রাজ্যের সংখ্যালঘু বিষয়ক এবং মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের কাছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, সংখ্যাগত ভাবে ব্রাহ্মদের অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, ফলে বিষয়টি রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত। সংখ্যালঘু বিষয়ক দফতর আলাপ-আলোচনা করে ব্রাহ্ম সমাজের স্বতন্ত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু তকমা বা স্টেটাস-এর দাবি নাকচ করে দেয়। বলা হয়, ব্রাহ্মরা হিন্দু ধর্মেরই একটি সেক্ট বা অংশ। একই সঙ্গে গত বছর তাদের হাতে থাকা ৮টি কলেজের পরিচালন সমিতিও ভেঙে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কী বক্তব্য? শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি রাজ্যকে বিবেচনা করতে বলেছিল। আমাদের মনে হয়েছে, ব্রাহ্মরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু স্টেটাস পেতে পারেন না। সেই যুক্তিতেই কলেজগুলির পরিচালন সমিতি ভেঙে দেওয়া হয়। এতে কোনও অন্যায় নেই।’’
কিন্তু সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায় এবং কার্যকরী সমিতির সদস্য সুব্রত দত্তের দাবি, কোনও ভাবেই তাঁরা হিন্দু ধর্মের অংশ নন। উনিশ শতকে ব্রাহ্ম আন্দোলনের অন্যতম মুখ কেশবচন্দ্র সেনকে উদ্ধৃত করে তাঁরা বলেন, হিন্দুধর্মের সমস্যাগুলি থেকে মুক্ত হতেই ব্রাহ্ম সমাজের উৎপত্তি। একই সঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, বর্তমান সমাজে হিন্দু ধর্মের নামে যা চলছে, তার থেকে তাঁদের দূরত্ব বহু যোজন।
বিশ্বজিৎবাবুর বক্তব্য, তাঁদের রীতিনীতির সঙ্গে হিন্দু রীতিনীতির বিস্তর তফাত। সুতরাং নিজেদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় অস্তিত্বের লড়াই তাঁরা চালু রেখেছেন। ১৯৫৫ সালের হিন্দু বিবাহ আইন উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, সেখানে ব্রাহ্মদের ভিন্ন ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় রাজ্য সরকার ব্রাহ্ম কলেজগুলিকে অধিগ্রহণ করার চেষ্টা করছে, তার তীব্র বিরোধিতা তাঁরা করছেন।
সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষে লড়াই করছেন আইনজীবী সায়ন দত্ত। তাঁর বক্তব্য, ১৯৬১ সালে বিহার হাইকোর্টে দীপেন্দ্রনাথ সরকার বনাম বিহার সরকারের মামলায় আদালত ব্রাহ্মদের পৃথক ধর্মীয় অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল। বিহার-ঝাড়খণ্ড তো বটেই, মুম্বই এবং দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ব্রাহ্মদের উপস্থিতি
আছে বলেও সমাজ কর্তৃপক্ষের দাবি। কিন্তু জনসুমারির রিপোর্ট থেকে ব্রাহ্মদের সংখ্যা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কারণ, অধিকাংশ সময়েই পদবির কারণে জরিপকারীরা ব্রাহ্মদের হিন্দু বলে ধরে নেন। অনেকে ‘ব্রাহ্ম’ বললে ‘ব্রাহ্মণ’ বোঝেন। স্বতন্ত্র স্টেটাস পেলে তাঁরা নিজেদের সংখ্যা সম্বন্ধে অবহিত হতে পারবেন বলে সমাজের দাবি। তাঁরা জানান, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজও এই লড়াইয়ে তাঁদের সঙ্গ দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সরকারের কাছে আসলে এই কলেজগুলির অধিকার পাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা চেষ্টা করছে কলেজগুলির অধিকার কুক্ষিগত করতে। সে কারণেই ব্রাহ্ম সমাজকে স্বতন্ত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুর স্টেটাস দিতে তারা নারাজ।