প্রতীকী চিত্র
অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধনী বিল পাস হওয়ায় অত্যাবশ্যক পণ্যের তালিকা থেকে বাদ পড়ল চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, গম, ভোজ্যতেল, তৈলবীজ। এই পণ্যগুলি মজুতের নিষেধাজ্ঞা বা দাম নির্ধারণের বিষয়টিও উঠে গেল। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, এতে চাষিদের এবং ক্রেতাদের উভয়েরই লাভ। কিন্তু সরকারের এই দাবি সঙ্গে বিরোধীরা তো নয়ই, সহমত হতে পারছেন না অনেকেই। তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন চাষি, তেমন রয়েছেন কৃষি আধিকারিকদের একাংশও। বীরভূমের বাসিন্দা, রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের এই বিল কৃষকদের হাহাকার ও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে। এই বিল শিল্পপতি, কর্পোরেট সংস্থা ও বড় ব্যবসায়ীদের কথা ভেবে তৈরি হয়েছে।’’
কেবল অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধনী বিল নয়, সংসদের দুই কক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশ করা নয়া দুই কৃষিবিল ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন), অন্যটি এগ্রিমেন্ট অফ প্রাইস অ্যাসিওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল— এই বিল দুটি নিয়েও দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, প্রথম বিলটির ফলে দেশের কোনও কৃষককে তাঁর উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য কেবল মাত্র মান্ডি বা এপিএমসি (এগ্রিকাল্চারাল প্রডিউস মার্কেট কমিটি)তে বিক্রি করতে হবে তার কোনও বাধ্যবাধকতা থাকবে না। একজন কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্য দেশের যে কোনও বাজারে মর্জিমাফিক দামে বিক্রি করতে পারবেন। দ্বিতীয় বিলটি অনুসারে একজন কৃষক ফসল উৎপাদনের আগেই ফসলের দাম নির্দিষ্ট করে কোনও সংস্থার সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক চাষ করতে পারেন।
কৃষিমন্ত্রীর প্রশ্ন, ‘‘কত জন চাষির পণ্য মজুত করার বা সেই পণ্য দেশের অন্যপ্রান্তে বিক্রি করার ক্ষমতা আছে?’’ তাঁর দাবি, এর ফলে মান্ডির ধারণা মুছে যাবে। তখন ধানের অভাবি বিক্রিও রোখা যাবে না। সেই সুযোগ বহুজাতিক সংস্থা, বাণিজ্যিক সংস্থা বা বড় ব্যবসায়ীরাই নেবেন। ঠকতে হবে চাষি ও ক্রেতাকেই। তাঁর কথায়, ‘‘চুক্তিভিত্তিক চাষ মানে তো ঘুরিয়ে কৃষকের কাছ থেকে ঘুরিয়ে জমির অধিকার কেড়ে নেওয়া। প্রথম প্রথম বেশি টাকা দিয়ে চাষিকে লোভ দেখানো, পরে তাঁকে বাধ্য করা হবে কম দামে ফসল বেচতে।’’ একই সুর সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদারও। তিনিও বলছেন, ‘‘তিনটি বিলই কৃষক বিরোধী। রাষ্ট্রপতির সই হয়ে গেলে গোটা দেশের কৃষি ব্যবস্থার উপর আঘাত আসবে। খাদ্য সঙ্কট তৈরি হবে। তাই প্রতিবাদ চলছে।’’
রাজ্য কৃষি বিভাগের এক আমলা বলছেন, ‘‘পঞ্জাব, হরিয়ানা, অন্ধ্রপ্রদেশর মতো মান্ডির ধারণা আমাদের রাজ্যে নেই। চাষিদে স্বার্থেই একাধিকবার তাতে সংশোধন হয়েছে। তাতে শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রিত বাজারেই একজন কৃষককে তাঁর পণ্য বেচতে হয় তেমনটা নয়।’’ তবে তাঁর মতে, ‘‘কেন্দ্রীয় ওই বিলের পরতে পরতে এমন কিছু বিষয় ঢোকানো রয়েছে যা রাজ্যের আইনের সঙ্গে বিরোধিতা করে। সবচেয়ে চিন্তার চুক্তিভিত্তিক চাষ। এখানে জমি না থাকুক কারও টাকা থাকলেই তিনি ‘চাষি’ হতে পারবেন।’’
চুক্তিভিক্তিক চাষ নিয়ে সন্দিহান চাষিরাও। ইলামবাজারের চাষি তপন সরকার বলছেন, ‘‘গত মরসুমে আলু চাষে যে লাভ চাষি পেয়েছে সেটা আশাতীত। সেই লাভ গত কয়েকবছরের দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে। এখন যদি চাষের শুরুতেই কোনও আলুচাষি ৫০ কিলো আলু আগাম চার থেকে পাঁচশো টাকা চুক্তিভিত্তিক চাষ করেন, সেই আলু পরে তো তাঁকেই ১৩০০ টাকা বা ২৩০০ টাকা দরে কিনে খেতে হবে। এতে কার লাভ হবে জানি না।’’ সিউড়ি ১ ব্লকের চাষি ভক্ত দাস দে-র মত, ‘‘আমি ৪০ রকম সুগন্ধি ধানের চাষ করি। আগাম চুক্তিতে ওই ধান বিক্রির ব্যবস্থা হলে ক্ষতি নেই, বরং লাভ। কিন্তু যে সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করছি, সেটা লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না দেখতে হবে সরকারকে।’’