শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় মোবাইলে গান চালিয়ে নাচ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বালকের। —নিজস্ব চিত্র।
‘‘তুমি বাইরে যেয়ো না। শরীর খারাপ হবে।’’ ‘লকডাউন’ শুরুর দিন চারেক পরে কথাটা শুনে চোখে জল চলে এসেছিল চন্দন শুক্লের। বাঁকুড়ার ওন্দা ব্লকের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিশোরী ফোন করেছিল বাবার মোবাইল থেকে। বিশেষ শিক্ষক চন্দনবাবুও সকাল-সন্ধ্যা ফোন করছেন ছাত্রছাত্রীদের। শিক্ষার্থী-শিক্ষকের ‘বিশেষ’ সম্পর্কের জোর আরও এক বার সামনে চলে আসছে করোনা-যুদ্ধের এই পর্বে।
হিন্দি ছবি ‘তারে জমিন পর’ (২০০৭)-এ ছোট্ট ঈশানের ছিল ডিসলেক্সিয়া নামে একটি অসুখ। অক্ষর চিনতে অসুবিধা হত। কিন্তু রং-তুলিতে অনর্গল মনের কথা বলে যেত সে। সবাই যখন ভুল বুঝছে, তখন নিকুম্ভ স্যর বদলে দেন তার জীবন। বাঁকুড়ার সমন্বয় শিক্ষা কো-অর্ডিনেটর রুমা দে জানান, ‘নিকুম্ভ স্যর’-এর মতো বিশেষ শিক্ষক ও শিক্ষিকা জেলায় রয়েছেন ৭২ জন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলেমেয়ে প্রায় ১৩ হাজার। তাদের মধ্যে মানসিক ভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হাজার দুয়েক।
ওই ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায় অন্যদের সঙ্গে। ব্লকের চক্র সম্পদবিকাশ কেন্দ্রে তাদের প্রতি সপ্তাহে পড়াতে যান বিশেষ-শিক্ষক-শিক্ষিকারা। ‘লকডাউন’ কী ও কেন, তা বুঝে উঠতে পারেনি তাদের অনেকেই। টানা বাড়িতে থেকে কিছুটা হাঁপিয়ে উঠছে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। অনেকেই স্কুলের ব্যাগটা নিয়ে এসে বাবা-মাকে বলছে, ‘‘যাই।’’
আরও পড়ুন: আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, আতঙ্কিত না হয়ে জেনে নিন করোনা-পরীক্ষার বিষয়ে
ইন্দাসের বিশেষ শিক্ষক চন্দনকুমার ঘোষ জানান, এক ছাত্র বাড়িতে খালি বায়না করছিল। ছেলেটির ‘ডাউন সিনড্রোম’ রয়েছে। অনুকরণমূলক কাজ ভাল রপ্ত করতে পারে। জানতে পেরে কথা বলেন চন্দনবাবু। ছাত্র তাঁকে বলে, ‘‘তুমি কোথায়? অনেক দিন নাচ শেখাচ্ছ না।’’
ছাত্রের বাবার মোবাইলে গান পাঠিয়ে দিয়েছিলেন চন্দনবাবু। সেই গানের সঙ্গে নাচে ছেলেটি। সেই নাচের ভিডিয়ো দেখে ‘স্যর’ তারিফ করতেই তার সব মনখারাপ উধাও।
খিল-আঁটা ঘরে অন্য দৃশ্যেরও জন্ম হচ্ছে। ইন্দাসের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বালিকা স্থানীয় স্কুলে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। কথা বলার সমস্যা রয়েছে। ‘স্পিচ থেরাপি’ চলছে। দিন কয়েক আগে প্রথম ‘মা’ বলে ডেকেছে সে। বিশেষ-শিক্ষক সৈয়দ হাবিবুর রহমান বলছিলেন, ‘‘মাকে এতটা সময় কাছে পাচ্ছে। এই সুযোগ মেয়েটির শেখার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত করে দিল।’’
এই দিনগুলিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলেমেয়েদের দিয়ে গাছে জল দেওয়া বা জামাকাপড় ভাঁজ করার মতো কাজ করাতে বলছেন হাবিবুর। ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘লকডাউন’-এর ‘রুটিন’ তৈরি করেছেন তিনি। ফোন করে বোঝাচ্ছেন অভিভাবকদের। বলছেন, রোজ বিকেলে তাদের ছাদে বা উঠোনে ঘুরিয়ে আনাটা খুব জরুরি।
আরও পড়ুন: রাজ্যে এল কেন্দ্রীয় দল, মোদীকে চিঠি ক্ষুব্ধ মমতার
রুমাদেবী জানান, ফোনে এমন যোগাযোগ সারা বছরই রাখেন বিশেষ-শিক্ষক-শিক্ষিকারা। তিনি বলছিলেন, ‘‘এ সবের জন্য সরকারি নির্দেশ আসার দরকার পড়ে না। বিশেষ-শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়ুয়াদের বাড়ির লোক হয়ে যান। বাবা-মায়ের পরে, তাঁদেরই সব থেকে ভরসার মানুষ মনে করে ছাত্রছাত্রীরা।’’
ভরসা তো বটেই। ঘরবন্দি জীবনেও ‘আছে তো হাতখানি’!
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)